বিজ্ঞান আলাপ

প্লুটোর ওপারে সম্ভাব্য নবম গ্রহ: সৌরজগতের এক নতুন রহস্য

মহাবিশ্ব জুড়ে অসংখ্য রহস্য লুকিয়ে আছে, যার অনেকটাই আমাদের জ্ঞানের বাইরে। সেইসব অজানা বিস্ময়ের এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে প্লুটোর ওপারে সম্ভাব্য এক নবম গ্রহের সন্ধান। বিজ্ঞানীদের মতে, সৌরজগতের প্রান্তে লুকিয়ে থাকা এই রহস্যময় গ্রহের অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে। প্লুটোকে যখন ২০০৬ সালে “বামন গ্রহ” হিসেবে পুনঃশ্রেণীকরণ করা হয়, তখন মনে করা হয়েছিল আমাদের সৌরজগতে আটটি গ্রহই চূড়ান্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া তথ্য ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।

নবম গ্রহের ধারণাটি নতুন কিছু নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের বাইরে এক অজানা গ্রহের অস্তিত্বের কথা ভাবছেন। প্রথমে নেপচুনের কক্ষপথে কিছু অস্বাভাবিক বিচ্যুতি লক্ষ্য করার পর “প্ল্যানেট এক্স” নামের একটি গ্রহের অস্তিত্বের কথা উঠে আসে। যদিও সেই সময় এ ধারণা বৈজ্ঞানিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, তবে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ আবারও নবম গ্রহের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

নেপচুনের বাইরে অবস্থিত কুইপার বেল্টে কিছু রহস্যময় বস্তু এবং তাদের অদ্ভুত কক্ষপথ প্রথম সন্দেহের জন্ম দেয়। বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেন, এসব বস্তু সূর্যের চারদিকে এমনভাবে ঘুরছে যা শুধুমাত্র কোনো বিশাল গ্রহের মহাকর্ষীয় টান দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এই পর্যবেক্ষণ নবম গ্রহের অনুসন্ধানকে নতুন মাত্রা দেয়।

২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (Caltech) জ্যোতির্বিদ মাইক ব্রাউন ও কনস্টান্টিন ব্যাটিগিন তাদের গবেষণায় দেখান, সৌরজগতের নির্দিষ্ট কিছু ট্রান্সনেপচুনিয়ান অবজেক্ট (TNOs) অস্বাভাবিকভাবে সারিবদ্ধ। এই কক্ষপথের অস্বাভাবিকতার পেছনে কোনো অজানা গ্রহের উপস্থিতিই সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা। তাদের গণনামতে, এই সম্ভাব্য নবম গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি ভরের এবং এটি সূর্য থেকে গড়ে ৩০০ থেকে ৭০০ ইউনিট (AU) দূরে অবস্থান করছে।

গবেষকদের মতে, এই নবম গ্রহটি হতে পারে ইউরেনাস বা নেপচুনের মতো একটি বরফ-গ্যাস দৈত্য। এটি সূর্য থেকে এতটাই দূরে অবস্থান করছে যে, সাধারণ টেলিস্কোপে সরাসরি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। গ্রহটির কক্ষপথ অত্যন্ত দীর্ঘায়িত এবং এটি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের তুলনায় অনেক ধীরগতিতে ঘোরে।

এর মহাকর্ষীয় প্রভাব এতটাই শক্তিশালী হতে পারে যে, এটি কুইপার বেল্টের বস্তুগুলোর কক্ষপথে অস্বাভাবিকতা তৈরি করে। এমনকি এটি সৌরজগতের কেন্দ্রের অক্ষীয় ঝোঁককেও প্রভাবিত করতে পারে। যদি এই গ্রহের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়, তবে এটি আমাদের সৌরজগতের গঠন এবং বিবর্তন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য প্রদান করবে।

নবম গ্রহের অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা উন্নত টেলিস্কোপ এবং কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করছেন। অত্যন্ত দুর্বল আলোর ইঙ্গিত শনাক্ত করতে বড় টেলিস্কোপগুলোকে বিশেষভাবে কনফিগার করা হচ্ছে। ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি, যা ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ কার্যক্রম শুরু করবে, এই অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কিন্তু এই গ্রহ শনাক্ত করা সহজ কাজ নয়। সূর্য থেকে এটির বিপুল দূরত্বের কারণে এটি অত্যন্ত ক্ষীণ এবং ধীর গতিতে চলমান, যা শনাক্তকরণকে কঠিন করে তোলে। মহাকাশের বিশালতা এবং প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এই অনুসন্ধানকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।

যদি এই গ্রহটি আবিষ্কৃত হয়, তবে এটি আমাদের সৌরজগতের সম্পর্কে বিদ্যমান ধারণাগুলিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে। এটি বোঝাতে পারে যে সৌরজগতে আরও অনেক অনাবিষ্কৃত বস্তু বা গ্রহ লুকিয়ে রয়েছে। একইসাথে এটি অন্যান্য নক্ষত্রপুঞ্জের চারপাশে অনাবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেট সম্পর্কেও মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে।

বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে নতুন প্রযুক্তি এবং অব্যাহত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তারা শীঘ্রই এই রহস্যময় নবম গ্রহের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন। এমনকি যদি তারা এই গ্রহের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে না পারেন, তবুও এই অনুসন্ধান মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল এবং জ্ঞানার্জনের প্রবণতাকে আরও গভীর করবে।

প্লুটোর ওপারে লুকিয়ে থাকা এই নবম গ্রহের অনুসন্ধান আমাদের সৌরজগতের সীমা এবং মহাকাশের অপরিসীম রহস্য উন্মোচনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা আমাদের মহাবিশ্বের অজানা অধ্যায়ের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্ল্যানেট নাইন খুঁজে পাওয়া বা না পাওয়া যাই হোক না কেন, এই অনুসন্ধান আমাদের মহাজাগতিক দিগন্তকে প্রসারিত করে চলেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button