হোলি সনাতন ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দময় উৎসব। এটি মূলত বসন্ত ঋতুর আগমনী উৎসব হিসেবে পালন করা হয় এবং ভারত, নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। হোলিকে “রঙের উৎসব” বলা হয়, কারণ এই দিনে মানুষ একে অপরকে রঙ মেখে শুভেচ্ছা জানায় এবং আনন্দ উদযাপন করে। হোলি উৎসবের মূল কাহিনি হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত একাধিক পৌরাণিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনি হল প্রহ্লাদ ও হিরণ্যকশিপুর গল্প। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, অসুর রাজা হিরণ্যকশিপু ছিলেন এক অহংকারী শাসক, যিনি নিজেকে ঈশ্বর মনে করতেন। কিন্তু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর একজন নিষ্ঠাভক্ত। হিরণ্যকশিপু চেয়েছিলেন প্রহ্লাদকে বিষ্ণুর উপাসনা থেকে বিরত রাখতে, কিন্তু ব্যর্থ হন। শেষে হিরণ্যকশিপু তাঁর বোন হোলিকার সহায়তা নেন, যিনি আগুনে পুড়ে না যাওয়ার বর পেয়েছিলেন। হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে বসেন, কিন্তু বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ রক্ষা পান এবং হোলিকা নিজেই পুড়ে মারা যান। এই ঘটনা থেকেই হোলি উৎসবের সূচনা। আগুনে হোলিকা দহনকে “হোলিকা দহন” বলা হয় এবং এটি হোলির আগের রাতে উদযাপন করা হয়। হোলি দুই দিনব্যাপী পালিত হয়। প্রথম দিন হোলিকা দহন অনুষ্ঠিত হয়। এই রাতে বড় বড় অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে হোলিকা দহন করা হয়, যা অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির বিজয়ের প্রতীক। মানুষ আগুনের চারপাশে ঘুরে প্রার্থনা করে এবং পুরনো দুঃখ, দ্বন্দ্ব পেছনে ফেলে নতুনভাবে জীবন শুরু করার সংকল্প করে। দ্বিতীয় দিন রঙ খেলা বা ধুলেটি পালিত হয়। এই দিনে মানুষ একে অপরের গায়ে আবির, গুলাল, রঙিন পানি ছিটিয়ে আনন্দ উদযাপন করে। বন্ধুবান্ধব, পরিবার, প্রতিবেশীরা একসঙ্গে খেলে, মিষ্টি খায় এবং উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেয়। হোলি উৎসবের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক তাৎপর্য গভীর। হোলিকা দহনের মাধ্যমে অশুভ শক্তির পরাজয় এবং সত্য ও ন্যায়ের বিজয় প্রতিফলিত হয়। এটি সমাজে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বার্তা দেয় এবং মানুষের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। বসন্তের আগমনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে নতুন জীবনের জাগরণ ঘটে এবং এই রঙিন উৎসব মানুষের মনেও নতুন আশার সঞ্চার করে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে হোলি ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে উদযাপন করা হয়। ব্রজ ও বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার রঙ খেলার স্মরণে হোলি বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। বারসানায় “লাঠমার হোলি” উদযাপিত হয়, যেখানে নারীরা পুরুষদের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উৎসব পালন করেন। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবর্তিত বসন্তোৎসব হোলির অনুপ্রেরণায় অনুষ্ঠিত হয়। হোলি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি সামাজিক সংহতি ও আনন্দময়তার প্রতীক। হোলির মাধ্যমে মানুষ বিভেদ ভুলে নতুনভাবে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই উৎসব সকলের মাঝে আনন্দ ছড়িয়ে দেয় এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যকে দৃঢ় করে।
