
মহাবিশ্ব রহস্যে ভরা। এর অসীম বিস্তৃতিতে লুকিয়ে রয়েছে নানা অজানা রহস্য, যার মধ্যে ওয়ার্মহোল বা কৃমিগহ্বর একটি চমকপ্রদ ধারণা। ওয়ার্মহোলকে মহাজাগতিক সংযোগস্থল বা মহাবিশ্বের শর্টকাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি এমন একটি তাত্ত্বিক কাঠামো, যা মহাবিশ্বের দুটি দূরবর্তী স্থান বা সময়কে সংযুক্ত করতে পারে। কিন্তু ওয়ার্মহোল আসলে কী? এটি কীভাবে কাজ করে? এবং এটি কি বাস্তবে সম্ভব? এই নিবন্ধে আমরা ওয়ার্মহোলের রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করব।
ওয়ার্মহোল হল মহাকাশ-কালের (স্পেস-টাইম) একটি তাত্ত্বিক কাঠামো, যা দুটি পৃথক স্থান বা সময়কে সংযুক্ত করে। এটিকে ইংরেজিতে “আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ” নামেও ডাকা হয়, কারণ আলবার্ট আইনস্টাইন এবং নাথান রোজেন প্রথম এই ধারণাটি প্রস্তাব করেছিলেন। ওয়ার্মহোলের ধারণা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা মহাকর্ষকে মহাকাশ-কালের বক্রতা হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
একটি ওয়ার্মহোলকে দুটি মুখ (মাউথ) এবং একটি গলা (থ্রোট) দিয়ে বর্ণনা করা হয়। মুখ দুটি হল প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ, আর গলা হল সংযোগকারী সুড়ঙ্গ। তাত্ত্বিকভাবে, যদি কেউ একটি ওয়ার্মহোলের এক মুখ দিয়ে প্রবেশ করে, তবে সে অন্যমুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে, যা মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি স্থান বা সময়ে অবস্থিত হতে পারে।
ওয়ার্মহোল বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, তবে প্রধান দুটি প্রকার হল:
১. ইন্ট্রা-ইউনিভার্স ওয়ার্মহোল: এই ধরনের ওয়ার্মহোল একই মহাবিশ্বের দুটি স্থানকে সংযুক্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি ওয়ার্মহোল পৃথিবী এবং একটি দূরবর্তী গ্যালাক্সিকে সংযুক্ত করে, তবে এটি ব্যবহার করে আমরা মুহূর্তের মধ্যে সেই গ্যালাক্সিতে পৌঁছাতে পারব।
২. ইন্টার-ইউনিভার্স ওয়ার্মহোল: এই ধরনের ওয়ার্মহোল দুটি ভিন্ন মহাবিশ্বকে সংযুক্ত করে। এটি মাল্টিভার্স তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত, যা বলে যে আমাদের মহাবিশ্ব ছাড়াও অসংখ্য সমান্তরাল মহাবিশ্ব থাকতে পারে।
যদিও ওয়ার্মহোলের ধারণা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে স্বীকৃত, তবে এর অস্তিত্ব এখনও প্রমাণিত হয়নি। ওয়ার্মহোলের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলি অত্যন্ত জটিল এবং অস্থিতিশীল। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী, ওয়ার্মহোল গঠনের জন্য “এক্সোটিক ম্যাটার” বা অস্বাভাবিক পদার্থের প্রয়োজন, যা নেতিবাচক শক্তি ঘনত্ব বিশিষ্ট। এই ধরনের পদার্থের অস্তিত্ব এখনও অনুমানমূলক, এবং এটি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও, ওয়ার্মহোলগুলি অত্যন্ত অস্থিতিশীল হতে পারে। সামান্য শক্তির পরিবর্তনেই এটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, যা এটিকে ব্যবহারের অযোগ্য করে তুলবে। তবে কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে উন্নত প্রযুক্তি এবং শক্তির উৎসের মাধ্যমে ওয়ার্মহোলকে স্থিতিশীল করা সম্ভব হতে পারে।
ওয়ার্মহোলের ধারণা সময়যাত্রার (টাইম ট্রাভেল) সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাত্ত্বিকভাবে, যদি একটি ওয়ার্মহোলের এক মুখ অন্য মুখের তুলনায় ধীর গতিতে চলে, তবে এটি সময়যাত্রার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ একটি ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে ভ্রমণ করে, তবে সে অতীত বা ভবিষ্যতে পৌঁছাতে পারে। তবে এই ধারণাটি এখনও সম্পূর্ণভাবে তাত্ত্বিক এবং এর বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
যদি ওয়ার্মহোলের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় এবং এটি স্থিতিশীল করা যায়, তবে এর সম্ভাব্য ব্যবহার অসীম। এটি মহাকাশ ভ্রমণে বিপ্লব ঘটাতে পারে, যেখানে আমরা মুহূর্তের মধ্যে দূরবর্তী গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রে পৌঁছাতে পারব। এছাড়াও, এটি সময়যাত্রার দরজা খুলে দিতে পারে, যা মানবসভ্যতার জন্য নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে।
ওয়ার্মহোল মহাবিশ্বের একটি চমকপ্রদ এবং রহস্যময় ধারণা। এটি আমাদের মহাকাশ এবং সময় সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। যদিও এর অস্তিত্ব এখনও প্রমাণিত হয়নি, তবে বিজ্ঞানীরা এই ধারণাটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো একদিন আমরা ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে মহাবিশ্বের দূরবর্তী প্রান্তে ভ্রমণ করতে পারব, বা এমনকি সময়ের স্রোতে পিছনে ফিরে যেতে পারব। যতদিন না পর্যন্ত এর রহস্য উন্মোচিত হয়, ততদিন ওয়ার্মহোল আমাদের কল্পনাশক্তিকে প্রজ্বলিত রাখবে এবং বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।