
আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিনটি বিশ্বব্যাপী নারীর অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়নের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার এক অনন্য উপলক্ষ। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর শেকড় আরও গভীরে, ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের গার্মেন্টস কারখানার শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলনের মাধ্যমে এর সূত্রপাত ঘটে। এরপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীরা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করে চলেছেন, এবং সমাজেও এসেছে পরিবর্তন। তবে এখনো লিঙ্গবৈষম্যের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন। উন্নত দেশগুলোতে নারীরা তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকলেও উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন, বৈষম্য ও অধিকারহরণের ঘটনা নিয়মিতই ঘটে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এখনও নারীদের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বৈশ্বিকভাবে নারী অধিকার রক্ষায় বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি রয়েছে, যেমন—নারী বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW), বেইজিং ঘোষণা (১৯৯৫), এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)। তবুও এখনো অনেক দেশেই নারীরা সমান মজুরি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।
নারী অধিকার আন্দোলনের ফলে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি ও বিজ্ঞানসহ নানা ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু নারী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, ক্রীড়া ও সাংবাদিকতায় নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তবে এখনও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার কারণে অনেক নারী তাদের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছেন না। পারিবারিক সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব নারীর অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:
১. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: নারীদের জন্য সমান শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থানের জন্য কারিগরি ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
২. আইনের কঠোর প্রয়োগ: নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন কার্যকর করা এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক।
৩. আর্থিক স্বনির্ভরতা: ক্ষুদ্র ঋণ, নারী উদ্যোক্তা সহায়তা, সমান মজুরির নীতি বাস্তবায়ন করা হলে নারীর আর্থিক ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে।
৪. সচেতনতা বৃদ্ধি: নারী অধিকারের বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারকে ভূমিকা রাখতে হবে।
৫. পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা: গৃহস্থালি ও পেশাগত জীবনে নারীদের নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
নারীর সমতা ও অধিকার নিশ্চিত করা শুধু নারীদের জন্য নয়, পুরো সমাজের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে নারীরা শিক্ষিত, কর্মক্ষম ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন, সেখানে দারিদ্র্যের হার কমে, স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হয়, এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ে। সুতরাং, নারী দিবস শুধুমাত্র একটি উদযাপনের দিন নয়, এটি একটি উপলক্ষ—একটি প্রতিজ্ঞা করার দিন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা আরও সমানতাভিত্তিক এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ে তুলতে পারি। নারীরা এগিয়ে গেলে, সমাজ এগিয়ে যাবে—এটাই হোক নারী দিবসের প্রতিশ্রুতি।