
মহাবিশ্বের গভীরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য রহস্য। আর এই রহস্য উন্মোচনের জন্য বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কারের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার (ESA) ইউক্লিড মিশন একটি অসাধারণ আবিষ্কার করেছে। এটি NGC 6505 ছায়াপথের চারপাশে একটি আইনস্টাইন বলয় পর্যবেক্ষণ করেছে, যা পৃথিবী থেকে প্রায় ৫৯০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে ড্রাকো নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত।
এই আইনস্টাইন বলয়টি মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের একটি চমকপ্রদ উদাহরণ। আইনস্টাইন বলয় কী? এটি একটি মহাজাগতিক ঘটনা, যেখানে একটি দূরবর্তী ছায়াপথ বা আলোর উৎস থেকে আগত আলো একটি মধ্যবর্তী ভরযুক্ত বস্তু দ্বারা বাঁকানো হয়। এই বাঁকানোর ফলে আলোটি একটি বলয়ের আকারে বিকৃত হয়। এই ঘটনাটি আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে মিলে যায়।
NGC 6505 ছায়াপথের চারপাশে দেখা এই বলয়টি তৈরি হয়েছে যখন প্রায় ৪.৪২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি নামহীন ছায়াপথ থেকে আগত আলো NGC 6505-এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র দ্বারা বাঁকানো হয়েছে। এই লেন্সিং প্রভাবের মাধ্যমে, পটভূমির ছায়াপথের একাধিক চিত্র তৈরি হয়েছে, যা একটি সুন্দর বলয়ের আকার ধারণ করেছে।
ইউক্লিড মিশন, যা ২০২৩ সালে চালু হয়েছিল, একটি প্রশস্ত-কোণ মহাকাশ টেলিস্কোপ। এটি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ এবং অন্ধকার শক্তি ও অন্ধকার পদার্থের রহস্য উন্মোচনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই মিশনের লক্ষ্য হল দূরবর্তী ছায়াপথগুলির লাল স্থানান্তর (redshift) অধ্যয়ন করে মহাবিশ্বের ইতিহাস এবং এর গঠন সম্পর্কে আরও জানা।
এই বলয়ের প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল ২০২৩ সালের শেষের দিকে ইউক্লিডের প্রাথমিক পরীক্ষার পর্যায়ে তোলা ছবি থেকে। মহাকাশযানের উচ্চ-রেজোলিউশন যন্ত্রগুলি এই পর্যবেক্ষণকে সম্ভব করেছে। এই আবিষ্কারটি শুধুমাত্র ইউক্লিডের প্রযুক্তিগত দক্ষতাই নয়, বরং এটি মহাবিশ্বের গভীর রহস্য উন্মোচনে কতটা কার্যকর হতে পারে তাও প্রমাণ করে।
এই আবিষ্কারটি বর্ণনাকারী গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক কনর ও’রিওর্ডান বলেছেন, ‘একটি আইনস্টাইন বলয় শক্তিশালী মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের একটি উদাহরণ। এটি বিশেষ কারণ এটি পৃথিবীর এত কাছাকাছি এবং সারিবদ্ধতা এটিকে খুব সুন্দর করে তোলে।
আইনস্টাইন বলয়গুলি অন্ধকার পদার্থ অনুসন্ধানেও সাহায্য করতে পারে। অন্ধকার পদার্থ হল একটি অদৃশ্য পদার্থ, যা মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের মাধ্যমে এর উপস্থিতি প্রকাশ করে। ইউক্লিড মিশনের লক্ষ্য হল এই অন্ধকার পদার্থের বণ্টন এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও জানা।
ইউক্লিড মিশন মহাবিশ্বের একটি বিশাল ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করবে, যা ১০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কোটি কোটি ছায়াপথকে ঘিরে থাকবে। এই তথ্য ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা অন্ধকার পদার্থ এবং অন্ধকার শক্তির বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করবেন।
ইউক্লিডের অভিযানের শেষ নাগাদ, এটি প্রায় ১০০,০০০ শক্তিশালী মহাকর্ষীয় লেন্স খুঁজে পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়াও, এটি দুর্বল মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের মাধ্যমে অন্ধকার শক্তির আরও সূক্ষ্ম প্রভাবগুলি অধ্যয়ন করবে।
ইউক্লিড মিশনের মাধ্যমে আইনস্টাইন বলয়ের এই আবিষ্কার মহাবিশ্বের গঠন এবং সম্প্রসারণ সম্পর্কে আমাদের বোঝাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এটি শুধুমাত্র মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের সৌন্দর্যকেই তুলে ধরে না, বরং অন্ধকার পদার্থ এবং অন্ধকার শক্তির রহস্য উন্মোচনের পথও প্রশস্ত করে। ইউক্লিডের মতো মিশনগুলি আমাদেরকে মহাবিশ্বের গভীরে পৌঁছাতে এবং এর অসীম রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করবে।
সংশ্লিষ্ট একজন গবেষক মন্তব্য করেছেন যে ইউক্লিড এই সমস্ত তথ্য দিয়ে ক্ষেত্রটিতে বিপ্লব ঘটাতে চলেছে যা আমরা আগে কখনও পাইনি।