
দারিদ্র্য বিশ্বব্যাপী একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যা, যা মানব উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই সমস্যা আরও প্রকট। সীমিত সম্পদ, দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক অবস্থান—এসবই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে দারিদ্র্য মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। তবে আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু দেশ দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই সম্পাদকীয়তে তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য মোচনের বর্তমান অবস্থান, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার কিছু অংশে দারিদ্র্যের হার এখনও উদ্বেগজনক। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৭০% দরিদ্র মানুষ বাস করে এই অঞ্চলগুলোতে। আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি, যেখানে প্রায় ৪০% মানুষ দৈনিক ১.৯০ ডলারেরও কম আয়ে জীবনযাপন করে। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ, নেপাল এবং পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু উন্নতি দেখা গেছে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো দারিদ্র্য মোচনে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। প্রথমত, অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি বড় সমস্যা। সম্পদের অসম বণ্টন এবং আয়বৈষম্য দারিদ্র্যকে আরও গভীর করে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় মানবসম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে বেশি মাত্রায় প্রভাবিত করে, যা কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে। চতুর্থত, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকে ব্যাহত করে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো দারিদ্র্য মোচনে কিছু সম্ভাবনাও ধারণ করে। প্রথমত, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, মোবাইল ব্যাংকিং এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব দারিদ্র্য মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দারিদ্র্য মোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। গত দুই দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ দারিদ্র্য মোকাবিলায় সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে, পোশাক শিল্পের বিকাশ এবং ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি লক্ষ লক্ষ মানুষের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। বাংলাদেশের এই সাফল্য তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
দারিদ্র্য মোচন তৃতীয় বিশ্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও এটি অসম্ভব নয়। সঠিক নীতি, সুশাসন, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে তাদের সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্য মোচনে এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে এই সংগ্রামে সমর্থন জোগাতে হবে। দারিদ্র্য মোচন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয় নয়, এটি মানবিক অগ্রগতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠারও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।