
বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং উন্নতির দীর্ঘ পথের মধ্যে আমরা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হওয়ার চাইতে দল ও দলের নেতৃত্বের প্রশ্ন প্রধান হয়ে উঠেছে। আমাদের রাজনৈতিক শ্রেণি বর্তমানে এমন একটি অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে দেশের সংকট এবং সমৃদ্ধি প্রশ্নে অনেকেই দলের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশের অগ্রগতি বা উন্নতির কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব একে অপরের উপর পড়ে না। এমনকি, আমরা এখনও ৫০ বছর পরেও ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, কিংবা এমন কোনো দেশের নাম নিতে বাধ্য হচ্ছি, যাদের আমরা নিজেদের আস্থার এবং ক্ষমতার যোগ্য বলে মনে করি না।
বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই আমাদের রাজনীতিতে দলীয়ভাবে বিভক্ততা প্রকাশ পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। এ কারণে, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। যদিও স্বাধীনতা আমাদের একটি নতুন দিশা দিয়েছিল, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেই সময় থেকেই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু নিয়ে লড়াই চলছিল। এই লড়াই কখনও দেশের জনগণের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিল, আবার কখনও নেতৃত্বের প্রতি।
যতই সময় গড়াতে থাকে, রাজনৈতিক দলগুলোর এই লড়াই আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কিন্তু দেশের কল্যাণের চিন্তা ততটা প্রবল হয়নি। আজকের দিনেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের স্থিতিশীলতা, জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নিয়ে নেতাদের মধ্যে কোনো ব্যাপক চিন্তা বা উদ্যোগ নেই। দলের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি এবং একে অপরকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা একদিকে যেমন দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভূমিকা সঠিকভাবে ফুটে উঠছে না। ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশ, পাকিস্তানের মতো পুরনো শত্রু, কিংবা আমেরিকার মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর নাম তুলতেই আমাদের গর্ব হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এখন তা আমাদের দুর্বলতা হিসেবে পরিণত হয়েছে। আজও আমরা তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা বা সম্পর্ক স্থাপনের জন্য মাথা নত করি, যেন আমাদের মানচিত্রের সার্বভৌমত্ব কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এটি এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে দেশের মানচিত্র সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতারা দেশের জন্য চিন্তা না করে নিজেদের দল এবং দলের নেতৃত্বকে সুরক্ষিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণরূপে দলীয় স্বার্থে আবদ্ধ। দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যকার সংঘর্ষ, একে অপরকে দোষারোপ এবং ক্ষমতার লড়াই কোনোভাবেই দেশের উন্নতির পক্ষে ফলপ্রসূ হতে পারে না। দেশের বৃহত্তর স্বার্থ অনেক সময় এই দলীয় ব্যবস্থার নিচে চাপা পড়ে যায়। জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সামগ্রিক উন্নয়ন অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। অতএব, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, দেশের কল্যাণের দিক থেকে কোনো প্রত্যক্ষ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর নির্ভর করছে না, বরং দেশের জনগণের মানসিকতা এবং ঐক্যবদ্ধতা উপরও ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে দেশবাসীকে একত্রিত করতে হবে, যেখানে সবার কল্যাণ ও উন্নয়ন সবার আগে থাকবে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা, রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি জনগণের সমর্থন এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি নৈতিক দায়িত্বশীলতা আমাদের পথ প্রদর্শন করবে। যদি আমরা দেশের উন্নতি এবং স্থিতিশীলতা চাই, তবে আমাদের দলের চিন্তা, দলীয় নেতৃত্বের লড়াই থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এমন এক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, যেখানে দলের রাজনীতি দেশের স্বার্থের চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে, সময় এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থে একত্রিত হতে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব এবং উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে। তবেই আমরা ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা বা অন্য কোনো দেশকে যাঁদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করার ভয় নেই, তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারব।