
আমরা প্রায়ই বিভিন্ন মিডিয়া সূত্র থেকে খবর পাই যে—মহাবিশ্বের কোনো এলাকায় জীবনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এবং গ্রহ পাওয়া গেছে। এই তথ্য পুরোপুরি মিথ্যে নয়। তবে শব্দচয়ন লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, বলা হচ্ছে—জীবনের জন্য উপযোগী পরিবেশের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোনো গ্রহ বা যেটিকে আমরা ‘এক্সোপ্ল্যানেট’ নামে চিনি, সেটি শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু কখনোই কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়নি যে, ওই পরিবেশে জীবনের অস্তিত্বের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া গেছে। শব্দ ব্যবহারের এই সূক্ষ্ম পার্থক্য থেকেই পরিষ্কার হয় যে—হাজার হাজার এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্তের দাবি থাকলেও, কোনো একটিতেও জীবনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আসলে কোনো গ্রহে জীবন গড়ে ওঠা খুব সহজ এবং সাধারণ ঘটনা নয়। শুধু উপযুক্ত পরিবেশ থাকলেই জীবন গাছের মতো তরতর করে গজিয়ে উঠবে—এমন ভাবনা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। জীবন একটি অত্যন্ত জটিল ও দুর্লভ প্রক্রিয়া, যা দীর্ঘ সময়ের বিবর্তন এবং অসংখ্য জটিল ধাপ ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সজীব হয়ে উঠতে পারে। পৃথিবীতে জীবন গড়ে ওঠার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আজকের নিবন্ধে আমরা অনুসন্ধান করবো—কেন অন্য কোনো গ্রহে বা মহাবিশ্বের অন্য কোথাও সহজে জীবন খুঁজে পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।
মহাবিশ্বের বিশালতা এবং রহস্যময়তা আমাদের চিন্তার সীমানাকে প্রসারিত করে। প্রতি রাতে আমরা যখন আকাশের দিকে তাকাই, অসংখ্য নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সির আলো আমাদের চোখে ধরা পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই বিশাল মহাবিশ্বে কি শুধুমাত্র পৃথিবীতেই জীবন আছে? নাকি অন্য কোথাওও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে মহাবিশ্বের প্রকৃতি এবং জীবনের সম্ভাব্য শর্তগুলো।
মহাবিশ্ব এতই বিশাল যে আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতেই প্রায় ১০০ বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে। আর মহাবিশ্বে এমন গ্যালাক্সির সংখ্যা প্রায় ২০০ বিলিয়ন। এই সংখ্যাগুলো আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো। এই বিশালতার মধ্যে পৃথিবী শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র বিন্দু। তাহলে কি এই বিশাল মহাবিশ্বে শুধুমাত্র পৃথিবীতেই জীবন আছে? এটি খুবই অসম্ভব বলে মনে হয়।
জীবনের জন্য কিছু মৌলিক শর্ত প্রয়োজন। যেগুলো ছাড়া জীবন অসম্ভব, যেমন:
১. পানি: পৃথিবীতে জীবন গড়ে উঠেছে পানির উপর ভিত্তি করে। পানি শুধুমাত্র জীবনধারণের জন্য নয়, রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্যও অপরিহার্য।
২. উপযুক্ত তাপমাত্রা: জীবনের জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা প্রয়োজন। খুব গরম বা খুব ঠান্ডা পরিবেশে জীবন টিকতে পারে না।
৩. বায়ুমণ্ডল: বায়ুমণ্ডল জীবনের জন্য অপরিহার্য। এটি ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে রক্ষা করে এবং প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করে।
৪. জৈব যৌগ: কার্বন-ভিত্তিক যৌগ জীবনের ভিত্তি। কার্বন অন্যান্য উপাদানের সাথে সহজেই যুক্ত হয়ে জটিল অণু তৈরি করতে পারে।
এক্সোপ্ল্যানেট হলো সেইসব গ্রহ যারা আমাদের সৌরজগতের বাইরে অবস্থিত। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে হাজার হাজার এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করেছেন, যাদের মধ্যে কিছু গ্রহ তাদের নক্ষত্রের হ্যাবিটেবল জোনে অবস্থিত। হ্যাবিটেবল জোন হলো সেই অঞ্চল যেখানে তাপমাত্রা তরল পানির অস্তিত্বের জন্য উপযুক্ত।
মহাবিশ্বের বিশালতা এবং এক্সোপ্ল্যানেটের সংখ্যা বিবেচনা করলে, এটি খুবই সম্ভব যে অন্য কোথাওও জীবন রয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, সেই জীবন কি আমাদের মতো জটিল এবং বুদ্ধিমান? নাকি তা মাইক্রোবিয়াল পর্যায়ে সীমাবদ্ধ?
ফার্মি প্যারাডক্স হলো একটি বিখ্যাত প্রশ্ন: “যদি মহাবিশ্বে এতসব সভ্যতা থাকে, তাহলে তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ কেন হয়নি?” এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। সম্ভবত মহাবিশ্বের বিশালতা এবং সময়ের সীমাবদ্ধতা এর কারণ। অথবা, হয়তো আমরা এখনও প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম নই। এভাবেও বলা যায় যে পৃথিবী জীবন গড়ে উঠতে যেই ধরনের মহাজাগতিক সাহায্য পেয়েছে এবং বাধা অতিক্রম করতে পেরেছে সেটা খুবই বিরল ঘটনা। কারণ জীবন নিজেই এক জটিল এবং দুর্লভ প্রতিক্রিয়া যেটা অতিক্রম করা সব গ্রহে সম্ভব হয়নি, হলেও একই সাথে পৃথিবীর জীবনের মতো সব সাফল্য এবং বাধা অতিক্রম না হওয়ার কারণে হয়তো থমকে আছে। অথবা মহাজাগতিক এমন দেওয়াল রয়েছে যা একে ওপরের সাথে সংযোগ হওয়ার পথে প্রাচীরের মতোই কাজ করছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই তত্ত্ব যদিও এটা প্যারাডক্স হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে।
মহাবিশ্বের বিশালতা এবং জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো বিবেচনা করলে, এটি খুবই সম্ভব যে অন্য কোথাওও জীবন রয়েছে। তবে সেই জীবন কি আমাদের মতো জটিল এবং বুদ্ধিমান, তা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করছেন এবং তাদের বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছেন। হয়তো একদিন আমরা এই প্রশ্নের উত্তর পাবো এবং জানতে পারবো যে আমরা এই বিশাল মহাবিশ্বে একা নই।
মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের এই যাত্রায় আমরা সবাই অংশীদার। প্রতিটি নতুন আবিষ্কার আমাদের এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় এই প্রশ্নের উত্তরের দিকে: “আমরা কি একা?”