বিজ্ঞান আলাপ

এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ (ELT): মহাবিশ্ব অনুসন্ধানের নতুন দ্বার

এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ (Extremely Large Telescope – ELT) হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং অত্যাধুনিক অপটিক্যাল ও ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ, যা মহাবিশ্বের অজানা রহস্য উন্মোচনের লক্ষ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে। ইউরোপীয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরি (ESO) কর্তৃক পরিচালিত এই প্রকল্পটি চিলির আটাকামা মরুভূমিতে স্থাপন করা হচ্ছে, যেখানে পরিষ্কার আকাশ এবং নিম্ন আর্দ্রতা উন্নত মানের পর্যবেক্ষণের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে।

ELT-এর নির্মাণ এবং কাঠামো

২০১৪ সালে ELT নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং এটি ২০২৭ সালের মধ্যে পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। টেলিস্কোপটির প্রধান আয়না (Primary Mirror) ৩৯.৩ মিটার ব্যাসের, যা এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম অপটিক্যাল টেলিস্কোপে পরিণত করবে। এই বিশাল আয়নাটি ৭৯৮টি পৃথক হেক্সাগোনাল খণ্ড নিয়ে গঠিত, যা একসঙ্গে কাজ করে মহাবিশ্বের দূরবর্তী বস্তুগুলোর অত্যন্ত স্পষ্ট ছবি ধারণ করবে।

ELT একটি পাঁচ-আয়না ব্যবস্থা ব্যবহার করছে, যা বর্তমানের অন্যসব বৃহৎ টেলিস্কোপের তুলনায় আরও উন্নত। এতে ব্যবহৃত অ্যাডাপ্টিভ অপটিক্স (Adaptive Optics) প্রযুক্তি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কারণে সৃষ্ট আলোর বিকৃতি দূর করে, ফলে মহাজাগতিক বস্তুগুলোর অনেক স্পষ্ট এবং নিখুঁত চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়।

প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য

১. প্রধান আয়না (M1): ৩৯.৩ মিটার ব্যাসের, ৭৯৮টি হেক্সাগোনাল অংশ নিয়ে গঠিত।
২. গৌণ আয়না (M2): ৪ মিটার ব্যাসের, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গৌণ আয়না।
৩. অ্যাডাপ্টিভ অপটিক্স: আলোর বিকৃতি সংশোধনের জন্য উন্নত প্রযুক্তি।
৪. স্পেকট্রোগ্রাফ: বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে আলো বিশ্লেষণ করে মহাজাগতিক বস্তুগুলোর গঠন ও উপাদান নির্ধারণ।
৫. ডোম স্ট্রাকচার: বিশাল টেলিস্কোপটি ৮৫ মিটার ব্যাস এবং ৭৪ মিটার উচ্চতার ডোমে সংরক্ষিত থাকবে।

গবেষণার লক্ষ্য এবং সম্ভাবনা

ELT টেলিস্কোপটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রাখবে। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের অজানা প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান সহজতর হবে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণার ক্ষেত্র নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. এক্সোপ্ল্যানেট অনুসন্ধান:
ELT এমন শক্তিশালী হবে যে এটি পৃথিবীর মতো ছোট গ্রহের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারবে। এই টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এক্সোপ্ল্যানেটগুলির বায়ুমণ্ডল পরীক্ষা করতে পারবেন এবং সেখানে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাব্য সংকেত খুঁজে পাবেন।

২. গ্যালাক্সির উৎপত্তি ও বিবর্তন:
ELT প্রাচীনতম গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হবে, যা মহাবিশ্বের জন্মের ঠিক পরপরই গঠিত হয়েছিল। এই পর্যবেক্ষণ আমাদের গ্যালাক্সির উৎপত্তি এবং এর বিবর্তন সম্পর্কে নতুন তথ্য সরবরাহ করবে।

৩. ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি গবেষণা:
মহাবিশ্বের ৯৫ শতাংশই ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি দ্বারা গঠিত, যার প্রকৃতি এখনো রহস্যময়। ELT-এর মাধ্যমে এই রহস্যময় উপাদানগুলির প্রকৃতি আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে।

৪. ব্ল্যাক হোল পর্যবেক্ষণ:
সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলোর গঠন এবং তাদের আশেপাশের পরিবেশ বিশ্লেষণে ELT একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি ব্ল্যাক হোল এবং ছায়াপথের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পর্কে নতুন তথ্য সরবরাহ করবে।

৫. মহাবিশ্বের প্রসারণ হার নির্ধারণ:
ELT-এর উন্নত প্রযুক্তি মহাবিশ্বের প্রসারণ হার আরও নির্ভুলভাবে পরিমাপ করতে সাহায্য করবে, যা মহাবিশ্বের ভবিষ্যত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেবে।

বিশ্বে ELT-এর ভূমিকা

এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ শুধুমাত্র জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয়, বরং সমগ্র বিজ্ঞানের জগতে একটি যুগান্তকারী সংযোজন। এই টেলিস্কোপের মাধ্যমে মানবজাতি মহাবিশ্ব সম্পর্কে এমন তথ্য জানতে পারবে যা বর্তমান প্রযুক্তিতে সম্ভব নয়। এটি আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞানের সীমানাকে বহুদূর প্রসারিত করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নতুন গবেষণার পথ খুলে দেবে।

ELT নির্মাণের মাধ্যমে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সূচনা থেকে প্রাণের উৎস পর্যন্ত প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে সক্ষম হবেন। এটি একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ, যা আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে বোঝার সীমা বাড়িয়ে দেবে এবং মানবতার কৌতূহল মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button