
বিকেলে ট্রেনিং অফিসের শেষ সেশন শেষ করে বাড়ি ফেরার আগে অফিসের একদম সিঁড়ির কাছের ছোট্ট কফি শপে ঢুকে সবেমাত্র কফির অর্ডার করেছি, এই সময় আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করতেই নামটা চোখে পড়ল, ইমতু, আমার বন্ধুর একমাত্র মেয়ে। রাজশাহীর একটি মহিলা মেসে থেকে নামকরা একটি কলেজে পড়ছে ও। আমার সাথে ওর বাবার যেমন বন্ধুত্ব, তেমনই ঘনিষ্ঠ ওর পুরো পরিবার। দুই পরিবারের মধ্যে বহুদিন থেকে নিত্য যোগাযোগ। একটা ভালো বন্ধন আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে বহুদিন থেকেই।
-
হ্যালো মা ইমতু। বলো কেমন আছো?
-
চাচু, তুমি কি রাজশাহীর ট্রেনিংয়ে এসেছো আজ?
-
হ্যাঁ মা, কেন? কোনো সমস্যা? কিছু লাগবে তোমার?
-
না চাচু, আমি তোমাদের অফিসের কাছাকাছি একটা মার্কেটে। তুমি কোথায় বলো আমি দেখা করব।
-
ও আচ্ছা, এসো মা, আমি অফিসের নীচের কফি শপে আছি। এসো কফি খাব একসঙ্গে।
ইমতু মোবাইল রেখে দিল। মিনিট দশেক পর ওকে কফি শপের বাহির থেকে ভিতরে ডেকে নিলাম। কফি অর্ডার দেব, কিন্তু ইমতুর চোখমুখ দেখে খটকা লাগল।
-
কফি খাবে না?
-
না চাচু, তুমি খাও।
কথা বলতে বলতে ইমতু ওর মোবাইল ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। ফেসবুক মেসেঞ্জার অন করে আমার সামনে টেবিলের ওপর রাখল। “এই ইনবক্সটা আমার চাচু, এবার খুব ভালো করে এসএমএসগুলো দেখ।”
আমি ওর শক্ত হয়ে আসা চোখমুখের দিকে তাকিয়ে ওর মোবাইলটা টেনে নিলাম কাছে। এরপর যা দেখলাম সেটা আমার এই জীবনে দেখা সব থেকে লজ্জার ঘটনা। মাথা তুলতে পারছি না। মনে হচ্ছে ঘাড়ের ওপর যম বসে আছে। কপাল ঘামতে লাগল বর্ষার বৃষ্টির মতো। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বাবা তার মেয়ের ছদ্মনামের আইডি চিনতে না পেরে কী সর্বনাশটা করে ফেলেছে। সুজনের আইডি থেকে তারই মেয়েকে অশ্লীল ইঙ্গিত আর অশ্লীল ছবি সেন্ড করেছে। আমি কী বলব বুঝতে পারছি না।
- চাচু, এটা কি আমার বাবা? বাবা বলে ডাকা যায় চাচু?
ওর প্রশ্নটাই আমার মুক্তির পথ যেন খুলে দিল। হুট করে মাথায় বুদ্ধিটা চেপে বসল আমি ভেবে দেখার আগেই। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এই জটিল সমস্যা থেকে উঠে আসার জন্য।
সন্তানের সঙ্গে পিতার লম্বা একটা দূরত্ব আমি স্পষ্ট অনুভব করছি। যেটা দিনকে দিন ঝড়ের আকার ধারণ করবে। পুরো পরিবার জ্বলবে, তছনছ হয়ে যেতে পারে। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে সুজন, ইমতু, আর তার প্রভাব পড়বে ভাবির ওপরেও। ওহ গড!
“ইয়ে মানে মা, ইমতু–“
-
কী, বন্ধুর হয়ে এখন ওকালতি করবে চাচু? আমি চিন্তা করতে পারছি না আমার বাবা একজন মানসিকভাবে বিকৃত মানুষ, এরকম বিকৃত যে–“
-
মারে, এটা তোর বাবার কাজ না মা। হলে তো অবশ্যই ওকালতি করতাম। এখন নিজের ওকালতি আমি নিজেই কীভাবে করি আর সেটা তোমাকে কীভাবে বিশ্বাস করাই মামণি!
-
হোয়াট? কী বলতে চাইছো চাচ্চু?
-
মা ইমতু, তুমি তো জানো তোমার চাচি আমাকে কতটা ভালোবাসেন এবং সেই সূত্রেই সে আমাকে অন্য মেয়েদের বিষয়ে কতটা সন্দেহ করে। আমি ফেসবুক চালাতে পারব না, হোয়াটসঅ্যাপ না। তোমার চাচি খুব নজর রাখে, এজন্যই আমি বাধ্য হয়ে কৌশলে তোমার বাবার ছবি ব্যবহার করে এই অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম যাতে তোমার চাচি কোনোদিন কোনোভাবেই ধরতে না পারে এবং আমাকে বিরক্ত না করে। আর এটা যে তোমার অ্যাকাউন্ট জানতাম না, ছদ্মনাম ব্যবহার করে খুলেছ যে কারণে মিস্টেক হয়েছে মা। চিনতে পারিনি। এটা তোমার বাবা না মা, বিশ্বাস করো, এটা আমার পাপ। ক্ষমা করো মা। আমি জোর হাত করে ক্ষমা চাইছি আর তওবা করছি, আমি আর কখনোই ফেসবুক ব্যবহার তো দূরে থাক মোবাইল সাবধানে ব্যবহার করব কোনো প্রয়োজন হলে।
ইমতু উঠে দাঁড়াল, ওর চোখমুখ আরও শক্ত হয়ে গেছে। আমি সাহস পেলাম না মাথা উঁচু করে থাকতে। পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে আমার। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ইমতুর গাল ভর্তি থুতু রেডি, যেকোনো সময় ছুড়ে মারবে আমার চোখমুখে।
- চাচু! এটা কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলছো? আমি তোমাকে চিনি না চাচু!
আমি সত্যিই মাথা তুলতে পারছি না। ওভাবেই মাথা নিচু করে আবারও বললাম:
- মারে। এক রুমে থেকেও তোমার চাচি আমাকে চিনতে পারেনি। সেদিক থেকে এটা তোমার দোষ না মা। এটা আমার চরিত্রের অন্যতম কৌশল এবং দোষ মা। তবে বিশ্বাস করো, আমি কান ধরে তওবা করছি, এরপর আর কোনোদিনই তুমি এরকমটা দেখবে না আমার মধ্যে।
ইমু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে নীরবে চলে গেল। যাবার আগে ফেলে যাওয়া ওর দীর্ঘশ্বাস আমাকে জানিয়ে দিল যে আমি সফল হয়েছি। ইমতু গেট ওভার হতেই আমি ঝট করে মোবাইলটা তুলে নিলাম। এখনই সুজনকে ওর ফেসবুক ডিলিট করতে বলতে হবে। ইমতুর ঘটনাটা ওর জানা উচিত এখনই। যাতে ও আগেই তৈরি থাকতে পারে। খুলে বলে রেডি করতে হবে ইতরটাকে।
বহুদিন পর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার অফিসের গাড়ির অপেক্ষা করছি, এই সময় একটা অটো থেকে ইমতু নামল। দীর্ঘদিন পর ইমতুর সাথে দেখা। ওর সাথে চোখাচোখি হতেই এক গাল থুতু ইমতু মাটিতে ফেলে গজ গজ করতে করতে চলে গেল। ওর চোখমুখে পৃথিবীর সমস্ত ঘৃণা দেখতে পেলাম। যেই ঘৃণাটা ওর বাবা সুজনের প্রাপ্য ছিল।
লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে এগিয়ে আসা আমার অফিসের গাড়িতে উঠে পড়লাম।