“যতবার দূর থেকে পৃথিবী দেখেছি, ততবার ফেরার স্বপ্ন দেখেছি।” – এমন অনুভূতি যে কতটা গভীর হতে পারে, তা সহজে বোঝা যায় না। তবে মহাকাশে আটকে থাকা একজন নভোচারীর জন্য এই স্বপ্ন বাস্তবে ফিরতে পারার চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা (NASA) এবং স্পেসএক্স (SpaceX)-এর যৌথ প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ২৮৬ দিন পর অবশেষে পৃথিবীর মাটিতে নিরাপদে ফিরে এসেছেন দুই মহাকাশচারী—সুনীতা উইলিয়ামস (Sunita Williams) এবং বুচ উইলমোর (Butch Wilmore)।
২০২৪ সালের ৫ জুন, পরিকল্পনা ছিল মাত্র আট দিনের এক সংক্ষিপ্ত মিশন। বোয়িং স্টারলাইনার (Boeing Starliner) মহাকাশযানে চড়ে তাঁরা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (ISS) গিয়েছিলেন। কিন্তু কারিগরি ত্রুটির কারণে সেই আট দিনের সফর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যায়। আট মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাঁদের ফিরে আসার কোনো নিশ্চিত পথ ছিল না। পৃথিবীর বাইরে ভাসমান অবস্থায় চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেই দিন কাটছিল।
যেভাবে আটকে পড়েন তাঁরা।
মহাকাশ অভিযানে যাত্রার সময়ই বোয়িং স্টারলাইনারে একাধিক কারিগরি সমস্যা ধরা পড়ে। মূলত জ্বালানির লিক এবং থ্রাস্টার (Thruster) ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে তাঁদের পৃথিবীতে ফিরে আসার পরিকল্পনা বারবার বিলম্বিত হয়। স্টারলাইনার মহাকাশযানটি নাসা এবং বোয়িং-এর নতুন যৌথ প্রকল্প হলেও, এই ব্যর্থতা মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
এই আটকে থাকার সময় তাঁদের মানসিক দৃঢ়তা এবং শারীরিক সক্ষমতা কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়ে। অভিকর্ষহীন পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাটানোর ফলে শরীরের পেশী এবং হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি, মহাজাগতিক রেডিয়েশনের প্রভাব তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
মহাকাশে জীবনের চ্যালেঞ্জ
অভিকর্ষহীন পরিবেশে দীর্ঘদিন কাটানোর ফলে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। শূন্য মাধ্যাকর্ষণে দেহের পেশী দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া, মহাকাশের বিকিরণ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
এই দীর্ঘ সময়ে সুনীতা এবং উইলমোর তাঁদের কাজের মধ্যে নিজেদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন। মহাকাশ গবেষণার বিভিন্ন পরীক্ষায় মনোনিবেশ করা এবং পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখাই তাঁদের মনোবল ধরে রাখতে সহায়ক হয়।
ফেরার সংকল্প এবং বিপদ
দীর্ঘ আট মাসের অপেক্ষার পর ২০২৫ সালের ১৯ মার্চ তাঁদের জন্য আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্পেসএক্সের ক্রু-১০ মিশনের মাধ্যমে অবশেষে পৃথিবীতে ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়। তবে ফেরার পথ সহজ ছিল না।
মহাকাশযানের পুনঃপ্রবেশ (Re-entry) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ধাপগুলোর একটি। উচ্চ তাপমাত্রা, তীব্র ঘর্ষণ এবং মহাকাশযানের অবস্থা তাঁদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারত। ফেরার পথে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—
পুনঃপ্রবেশের সময় তাপ সহ্য করার ক্ষমতা।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় তীব্র ঘর্ষণের ফলে মহাকাশযানের বাইরের অংশে সহস্র ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা তৈরি হয়।
প্ল্যাশডাউনের সময় নিরাপত্তা।
মহাকাশযানটি নির্দিষ্ট গতিতে নেমে আসার পর সমুদ্রে সফলভাবে অবতরণ করতে হয়। ছোট্ট একটি ভুল তাঁদের জীবন কেড়ে নিতে পারত।
মহাকাশযানের কারিগরি ত্রুটি।
দীর্ঘ আট মাস মহাকাশে থাকার ফলে যানের বিভিন্ন অংশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পুনরায় কাজ শুরু করা এবং নিরাপদে নামানো ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ।
অবশেষে ঘরে ফেরা
ফ্লোরিডার টালাহাসি উপকূলে তাঁদের মহাকাশযানের ‘স্প্ল্যাশডাউন’ হয়। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আট মাসের দীর্ঘ অপেক্ষা এবং চরম ঝুঁকির পর তাঁরা পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
ফেরার পরপরই তাঁদের একটি বিশেষ মেডিকেল পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় মহাকাশে থাকার ফলে তাঁদের শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হবে।
ভবিষ্যতের পথচলা
এই মিশনের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের মহাকাশ গবেষণার জন্য এক বিশাল শিক্ষা। বোয়িং স্টারলাইনারের কারিগরি ত্রুটি নিরসন এবং ভবিষ্যৎ অভিযানে এই ধরনের বিপর্যয় এড়াতে নাসা ইতিমধ্যেই নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
মহাকাশে আটকে থাকা এবং সফলভাবে ফিরে আসার এই গল্প শুধু বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। অদম্য মানসিক শক্তি, টিকে থাকার লড়াই, এবং ফেরার দৃঢ় সংকল্পই তাঁদের এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
এই মিশন আমাদের শেখায়, যত বড়ই বাধা আসুক, মানুষের ইচ্ছাশক্তি এবং বিজ্ঞান একত্রিত হলে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোরের এই রুদ্ধশ্বাস অভিযান চিরকাল মানবজাতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।