জ্যোতির্বিজ্ঞান

কৃষ্ণগহ্বর: মহাবিশ্বের রহস্যময় সত্তা

কৃষ্ণগহ্বর হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় ও বিস্ময়কর বস্তু, যার প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আলোকেও গ্রাস করে ফেলে। এর নামেই রয়েছে এর সারাংশ—‘কৃষ্ণ’ কারণ এটি অদৃশ্য, এবং ‘গহ্বর’ কারণ এটি মহাকাশে একটি শূন্যতার মতো। বিজ্ঞানীদের কাছে কৃষ্ণগহ্বর শুধু একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয় নয়, বরং এটি সময়, মহাকাশ এবং পদার্থের সীমানা নিয়ে গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে।

কৃষ্ণগহ্বর সাধারণত একটি বৃহৎ নক্ষত্রের জীবনচক্রের শেষ পর্যায়ে সৃষ্টি হয়। যখন একটি নক্ষত্রের জ্বালানি (হাইড্রোজেন) ফুরিয়ে যায়, তখন এটি নিজের মাধ্যাকর্ষণে সংকুচিত হতে থাকে। যদি নক্ষত্রটির ভর সূর্যের তুলনায় ৩ গুণের বেশি হয়, তবে এটি একটি বিশাল বিস্ফোরণের মাধ্যমে, যাকে সুপারনোভা বলা হয়, কৃষ্ণগহ্বরে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া, মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে বা গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অতি-ভারী কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হতে পারে, যার ভর সূর্যের লাখ থেকে বিলিয়ন গুণ।

কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে থাকে একটি অসীম ঘনত্বের বিন্দু, যাকে বিশিষ্টতা (Singularity) বলা হয়। এখানে মহাকাশ ও সময়ের সব নিয়ম ভেঙে পড়ে। এই বিশিষ্টতাকে ঘিরে থাকে ঘটনা দিগন্ত (Event Horizon), যা কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা। এই অদৃশ্য সীমানা অতিক্রম করলে কোনো কিছুই—এমনকি আলোও—বাইরে ফিরে আসতে পারে না।

কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে প্রায়ই একটি অ্যাক্রিশন ডিস্ক থাকে, যেখানে গ্যাস, ধূলিকণা ও অন্যান্য পদার্থ ঘূর্ণায়মান অবস্থায় থাকে। এই পদার্থগুলো উত্তপ্ত হয়ে এক্স-রশ্মি নির্গত করে, যা বিজ্ঞানীদের কৃষ্ণগহ্বর সনাক্ত করতে সহায়তা করে। কিছু কৃষ্ণগহ্বর থেকে উচ্চ-গতির কণার প্রবাহ বেরিয়ে আসে, যাকে রিলেটিভিস্টিক জেট বলা হয়।

কৃষ্ণগহ্বর বিভিন্ন ধরনের হতে পারে:

-নাক্ষত্রিক কৃষ্ণগহ্বর: নক্ষত্রের মৃত্যুতে সৃষ্ট, ভর সূর্যের ৩-১০০ গুণ।

-অতি-ভারী কৃষ্ণগহ্বর: গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত, যেমন আমাদের ছায়াপথের স্যাজিটেরিয়াস A*।

-মধ্যবর্তী কৃষ্ণগহ্বর: ভর সূর্যের ১০০ থেকে ১০,০০০ গুণ।

-আদিম কৃষ্ণগহ্বর: মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে সৃষ্টির তত্ত্ব, যা এখনো প্রমাণিত হয়নি।

কৃষ্ণগহ্বরের প্রবল মাধ্যাকর্ষণ আলোকরশ্মিকে বাঁকিয়ে দেয়, যা গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নামে পরিচিত। এটি দূরবর্তী নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির ছবি বিকৃত করে। এছাড়া, ঘটনা দিগন্তের কাছে সময় ধীরে চলে, যাকে গ্র্যাভিটেশনাল টাইম ডাইলেশন বলা হয়। এটি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের একটি প্রমাণ।
বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের তত্ত্ব অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বর কোয়ান্টাম প্রভাবের কারণে কণা নির্গত করে, যা হকিং বিকিরণ নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়ায় কৃষ্ণগহ্বর ধীরে ধীরে ভর হারায় এবং একসময় বাষ্পীভূত হয়ে যেতে পারে।

কৃষ্ণগহ্বর সরাসরি দেখা যায় না, তবে এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো নক্ষত্র যদি কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে ঘুরতে থাকে, তবে এর কক্ষপথের গতি থেকে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব নিশ্চিত করা যায়। ২০১৯ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ প্রথমবারের মতো একটি কৃষ্ণগহ্বরের ছায়ার ছবি তুলে বিশ্বকে বিস্মিত করে, যা M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত।

কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা মহাবিশ্বের গঠন, সময়ের প্রকৃতি এবং পদার্থের সীমানা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিচ্ছে। এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং সাধারণ আপেক্ষিকতার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের চাবিকাঠি হতে পারে। এছাড়া, কৃষ্ণগহ্বরের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ বা অন্য মহাবিশ্বে প্রবেশের সম্ভাবনা নিয়ে তত্ত্বীয় আলোচনা চলছে, যদিও এটি এখনো কল্পবিজ্ঞানের পর্যায়ে।

কৃষ্ণগহ্বর মহাবিশ্বের একটি অপ্রতিরোধ্য রহস্য, যা বিজ্ঞানীদের কল্পনা ও গবেষণাকে উদ্দীপ্ত করে। এটি শুধু একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বস্তু নয়, বরং মানুষের জ্ঞানের সীমানা পরীক্ষা করার একটি প্রতীক। ভবিষ্যতে আরো উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষ্ণগহ্বরের গোপন রহস্য উন্মোচিত হবে, এবং আমরা মহাবিশ্বের গভীরতর সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর সুযোগ পাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button