ধর্ম আলাপ

ধর্ম আর বিজ্ঞানের সম্পর্ক অনেকটা নদী ও সেতুর মতো

আল মামুন রিটন

মানব সভ্যতার উত্থান ও বিকাশে ধর্মের ভূমিকা অপরিসীম। প্রাচীন যুগে ধর্ম শুধু আধ্যাত্মিক চাহিদাই পূরণ করেনি, সমাজের নৈতিক ও সংহতির ভিত্তিও রচনাও করেছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতি, যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসার এবং মানবতাবাদের উত্থান ধর্মের ঐতিহ্যগত ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আজকের বিশ্বে এই তিনটি শক্তি—ধর্ম, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ—একসাথে সহাবস্থান করছে, কখনো সংঘাতের মধ্যে দিয়ে, আবার কখনো সমন্বয়ের পথ খুঁজে নিচ্ছে।

প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে ধর্ম ছিল আইন, নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। মেসোপটেমিয়া, মিশর, ভারত বা গ্রিস—সর্বত্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও দেবদেবীর উপাসনা সামাজিক কাঠামো গঠনে সহায়তা করেছিল। ধর্ম শান্তি, ন্যায়বিচার এবং সম্প্রদায়গত ঐক্য বজায় রাখার একটি ব্যবস্থা দিয়েছিল। কিন্তু এর সাথে জড়িয়ে ছিল কুসংস্কার, গোঁড়ামি এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিরোধিতা, যা পরবর্তীতে সংঘাতের জন্ম দেয়।

রেনেসাঁ এবং জ্ঞানালোকের যুগে বিজ্ঞান ধর্মের একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে। গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস বা ডারউইনের মত বিজ্ঞানীরা যখন ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত সত্য প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান প্রমাণ, যুক্তি ও পরীক্ষার মাধ্যমে জগৎব্যাখ্যার দাবিদার হয়ে উঠেছে, যা ধর্মের রহস্য ও অলৌকিকতাবাদকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

তবে এই সংঘাত চিরস্থায়ী নয়। অনেক ধর্মীয় চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানী (যেমন আইনস্টাইন বা টিলিখ) ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় খুঁজেছেন। তারা বলেছেন, ধর্ম আধ্যাত্মিক ও নৈতিক প্রশ্নের উত্তর দেয়, আর বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করে প্রাকৃতিক নিয়ম। এই দুটি ভিন্ন স্তরের সত্যকে একসাথে মেনে নেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।

আধুনিক যুগে মানবতাবাদ ধর্মের বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে। মানবকল্যাণ, যুক্তি, ন্যায় ও স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এই দর্শন ধর্মীয় কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করে। সমাজ যখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও মানবাধিকারের দিকে এগিয়েছে, তখন মানবতাবাদই হয়ে উঠেছে নৈতিকতার নতুন মাপকাঠি।

কিন্তু মানবতাবাদও সম্পূর্ণ সংঘাতমুক্ত নয়। কিছু ক্ষেত্রে এটি ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক, যেমন লিঙ্গসমতা বা ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নে। আবার অনেক ধর্মই এখন মানবতাবাদের সাথে সমন্বয় করছে—ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, সামাজিক ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে ধর্মের অংশগ্রহণ তার উদাহরণ।

আজকের বিশ্বে ধর্ম, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং পরস্পরকে সম্পূরক করতে পারে। বিজ্ঞান প্রগতি এগিয়ে নিচ্ছে, ধর্ম আশা ও আধ্যাত্মিক শান্তি দিচ্ছে, আর মানবতাবাদ নিশ্চিত করছে সমতা ও ন্যায়। অনেক বিজ্ঞানীই ধর্মীয়, অনেক ধার্মিক ব্যক্তি বিজ্ঞান ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী।

ভবিষ্যতের সমাজে এই তিন শক্তির মধ্যে সংলাপ ও সমন্বয়ই কাম্য। ধর্ম যদি কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা ত্যাগ করে, বিজ্ঞান যদি মানবিক মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দেয়, আর মানবতাবাদ যদি আধ্যাত্মিক চাহিদাকে উপেক্ষা না করে—তবেই একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও উন্নত বিশ্ব গড়ে উঠবে।

মনুষ্য সভ্যতার ইতিহাসে ধর্ম, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদের সম্পর্ক জটিল, কিন্তু গতিশীল। সংঘাতের বদলে যদি আমরা সমন্বয়ের দর্শন খুঁজে নিই, তবে এই ত্রয়ী শক্তি একত্রে মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে—জ্ঞানের আলোয়, নৈতিকতায় এবং সহমর্মিতায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button