
অপুষ্পক ও সপুষ্পক উদ্ভিদ সম্বন্ধে পণ্ডিতগণ সকলেই পরিচিত, কিন্তু অপুষ্পক ও সপুষ্পক প্রাণী বিষয়টি বড্ড অদ্ভুত ঠেকিতেছে যে মুখুজ্জি মশাই! এই বলিয়া দীনু মণ্ডল,ওরফে দীনু গোয়ালা অবাক হইয়া সুকোমল মুখার্জী মহাশয়ের দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল।
সুকোমলবাবু সার্থকনামা,বড়ই কোমলস্বভাব প্রকৃতির মানুষ। তিনি যৎসামান্য বিষয় লইয়া অসামান্য রসিকতা করিতে প্রচণ্ড ওস্তাদ। স্কুলের শিক্ষক জীবন সমাপ্তির পর সাহিত্য জগতে তাঁহার অধুনা যাতায়াত কাহারও অবিদিত নয়।
তিনি দীনুকে বলিলেন, শিক্ষক জীবনের দৌলতে বহু ছাত্রছাত্রী মানুষ করিয়াছি বটে,কিন্তু এইবার শিক্ষক জীবনে অবসর লইবার পর অতি অবসর পাইয়া নিজে পুনরায় ছাত্র হইয়া নিজেকে মানুষ করিতেছি।সেই নিমিত্ত সাহিত্যের ইন্ধন সঞ্চালন করিয়া অর্ধমৃত জ্ঞানাগ্নিতে ফুৎকার দিয়া পুনঃ প্রজ্জ্বলনের ব্যবস্থা করিতেছি!
অশিক্ষিত দীনু শিক্ষিত শিক্ষকের এহেন বাক্য শ্রবণ করিয়া কিছুই বুঝিতে না পারিয়া হাঁ হইয়া রহিল!
সুকোমলবাবু ইহা বুঝিতে পারিয়া দীনুকে বলিলেন, আচ্ছা দীনু, রবিঠাকুরের “দুই বিঘা জমি” কবিতাটি তুই পড়িয়াছিস?
দীনু বেচারা কিঞ্চিৎ ভাবিত হইয়া মস্তকোপরি কেশরাজি ঈষৎ চুলকাইয়া কহিল,না মাষ্টারমশাই, তবে কবিতাটি শুনিয়াছি বটে।
সুকোমলবাবু প্রসন্ন বদনে বলিলেন,উত্তম! উত্তম!তাহা হইলে উপেনের নাম শুনিয়াছিস নিশ্চয়?
দীনু কহিল, হ্যাঁ মাষ্টারমশাই।
এইবার সুকোমলবাবু বলিতে লাগিলেন, এই জমি অর্থাৎ ভূমি হইতেছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতে সংগৃহীত মূল রাজনৈতিক পটভূমি!ইহাই সমস্ত শিষ্টের নষ্টের মূল!
উপেন জমি হারাইয়া,গৃহ হারাইয়া ভিখারি হইয়া হৃদয়জমি চাষ করিতে বৃক্ষতলে আশ্রয় লভিতে বাহির হইয়াছিল। সেদিক হইতে,উপেনের বাবু ছিলেন একজন মহান দয়াবান সমাজসেবী মানুষ।
দীনু অবাক হইয়া বলিল, কী যে বলেন মাষ্টারমশাই কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না;জমি কাড়িয়া লওয়া তো ঘোরতর মহাপাপ!ইহা প্রচণ্ড অধার্মিক কাজ!
সুকোমলবাবু বলিলেন,পাপ নয় রে,পাপ নয়।ইহা হইতেছে রাজধর্মের মহাপুণ্য কাজের আবশ্যিক অঙ্গ বিশেষ!রাজধর্ম পালন না করিলে আর রাজা হওয়া কীসের রে? রাজধর্ম পালন না করাই হইল ঘোরতর মহাপাপ!
চিরকাল রাজা হইবে অত্যাচারী,জমি লুন্ঠনকারী,ভোগবিলাসী,প্রজাশোষক।ইহাই আদর্শ রাজার প্রকৃতি হিসাবে সর্বজনে সুবিদিত।যুগ যুগ হইতে রাজাগণ এইরূপে স্বীয় ধর্মের পুণ্যকর্ম পালন করিয়া আসিতেছেন।আর তাঁহাদের সুনিপুণ কার্যাবলি বর্তমানে রাজনীতির অত্যাবশ্যকীয় পালনীয় ধর্ম হিসাবে এক প্রকৌশলী পুণ্যকর্ম হিসাবে পরিচিত হইয়াছে।
একদা রাজার ছিল রাজদণ্ড, বর্তমানে রাজাহীন প্রজার জুটিয়াছে পতাকাদণ্ড! পতাকাদণ্ডটি আবার শোভিত হইতেছে নানাবিধ রাজনৈতিক দলের বর্ণময় পরিচিতির মানদণ্ড হিসাবে!
এই উদ্দেশ্যে অধুনা নানাবিধ পুষ্পশোভিত পতাকাদণ্ডেরও আবির্ভাব ঘটিয়াছে। যাহাদের পুষ্প-দুর্বলতা নাই, তাহারা অপুষ্পক বর্ণান্ধ প্রাণী বলিয়া রাজনৈতিক সমাজে অচ্ছুৎ হিসেবে সবিশেষ পরিচিতি লাভ করিয়াছে।যেমন আমি, আমি একপ্রকার অপুষ্পক প্রাণী। এই বলিয়া মাষ্টারমহাশয় দীনুর দিকে তাকাইয়া হাসিতে লাগিলেন।
দীনু আশ্চর্যান্বিত হইয়া কহিল,অপুষ্পক উদ্ভিদ শুনিয়াছি বটে, কিন্তু অপুষ্পক প্রাণী?নৈব নৈব চ!
সুকোমল বাবু অট্টহাস্যে ফাটিয়া পড়িলেন। বলিলেন,তুই দীনু গোয়ালা; দুধের হিসাব বুঝিস, কিন্তু গোরুর হিসাব কি তুই বুঝিস?
দীনু কহিল, না মাষ্টারমশাই।
তবে শোন্, এই গোরু হইতেছে বিশেষ একপ্রকার পুষ্পশোভিত পতাকায় বিশ্বাসী অতি সরল প্রাণী।এই উদ্দেশ্যে গোরু হইতেছে এক নিরীহ রাজনৈতিক সপুষ্পক প্রাণী।
দীনু কিঞ্চিত ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া কি বলিবে কিছুই বুঝিতে না পারিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া স্বস্থানে দাঁড়াইয়া রহিল!
ইত্যবসরে হঠাৎ তাহার মনে পড়িল, গোয়ালে গোরুদিগের জাব খাইবার সময় পার হইয়া যাইতেছে!সে তৎক্ষণাৎ মাষ্টারমহাশয়ের অনুমতি লইয়া তাঁহাকে নমস্কার করিয়া অতি সত্বর গৃহাভিমুখে যাত্রা করিল।
মাষ্টারমহাশয় দীনুর যাত্রাপথের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাইলেন এবং মৃদু হাসিয়া দক্ষিণহস্ত দ্বারা নাসিকার উপর চশমাটি সযত্নে পুনঃস্থাপন করিয়া সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করিলেন।