বিশ্ব আলাপ

ইতিহাস, তাৎপর্য ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট শ্রমিক দিবস

শ্রমিক দিবস বা মে দিবস বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক। এটি শুধু একটি দিবস নয়, বরং শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও অবদানের স্বীকৃতি। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এই দিনটি শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসকে স্মরণ করে এবং বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার দিকনির্দেশনা দেয়।

শ্রমিক দিবসের সূচনা হয়েছিল ১৯শ শতকের শিল্প বিপ্লবের সময়ে, যখন শ্রমিকরা অমানবিক পরিশ্রমের শিকার হতো। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিকরা “৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা ঘুম” এই দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলন রূপ নেয় ‘হেমার্কেট বিদ্রোহ’-এ, যেখানে পুলিশের গুলিতে বহু শ্রমিক নিহত হন। তাদের রক্তে রঞ্জিত এই সংগ্রামই পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের জন্ম দেয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে-কে “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশে শ্রমিক দিবসের ইতিহাস ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু। ব্রিটিশ শাসনামলে নীল চাষ, রেলওয়ে ও খনি শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন এবং পাকিস্তান আমলে শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে শ্রমিকরা, বিশেষ করে পাটশিল্প, গার্মেন্টস ও নির্মাণশিল্পে।

বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০% এর বেশি আসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাদের অধিকাংশই নারী। কিন্তু তাদের কর্মপরিবেশ, মজুরি ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধ্বসের মতো মর্মান্তিক ঘটনাগুলো শ্রমিক অধিকারের দুর্বলতা ফুটিয়ে তুলেছে। যদিও এরপর আইনি সংস্কার ও নিরাপত্তা মান উন্নীত হয়েছে, তবুও অনেক শ্রমিক এখনও ন্যূনতম মজুরি, চিকিৎসা সুবিধা ও ন্যায্য কর্মঘণ্টা থেকে বঞ্চিত।

আজকের বিশ্বে শ্রমিক দিবসের তাৎপর্য আরও গভীর। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটিক্স শ্রমবাজারে আমূল পরিবর্তন আনছে। অনেক ঐতিহ্যবাহী চাকরি হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, আবার নতুন ধরনের দক্ষতার চাহিদা বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন অপরিহার্য।

এছাড়াও, বিশ্বায়নের যুগে শ্রমিক অভিবাসন, বৈষম্য ও শ্রমিক শোষণ নতুন রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর শ্রমিক বিদেশে কাজ করলেও অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করেন। তাই, শ্রমিক দিবস কেবল অতীতের স্মরণ নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা।

শ্রমিক দিবস শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি সমাজের মৌলিক স্তম্ভ—শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার দিন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই দেশের অর্থনীতি সচল, তাদের সুখ-দুঃখই জাতির উন্নয়নের মাপকাঠি। তাই, আসুন আমরা সবাই মিলে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করি। একটি সুস্থ, সুন্দর ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করা হোক আমাদের অঙ্গীকার।

“শ্রমিকের মর্যাদাই জাতির সম্মান।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button