জ্যোতির্বিজ্ঞান

সৌরজগতের আটটি না নয়টি গ্রহ আছে, দাবী নতুন গবেষণার

আমাদের সৌরজগৎ দীর্ঘদিন ধরে আটটি গ্রহ নিয়ে গঠিত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে: বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন। ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংঘ (IAU) প্লুটোকে “বামন গ্রহ” হিসেবে পুনঃশ্রেণীবদ্ধ করার পর থেকে সৌরজগতের গ্রহের সংখ্যা আটটি হিসেবে স্বীকৃত। তবে, সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং দাবি করছে যে সৌরজগতে একটি নবম গ্রহ থাকতে পারে।

২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (ক্যালটেক) গবেষক কনস্টানটিন ব্যাটিজিন এবং মাইকেল ব্রাউন একটি গবেষণায় প্রস্তাব করেন যে সৌরজগতের বাইরের অংশে একটি বৃহৎ গ্রহের অস্তিত্ব থাকতে পারে, যাকে তারা “প্ল্যানেট নাইন” নামে অভিহিত করেন। এই সম্ভাব্য গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১০ গুণ ভরের এবং নেপচুনের তুলনায় ২০ গুণ দূরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার, এবং সূর্যের চারদিকে একবার পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে এর ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ বছর সময় লাগতে পারে।

গবেষকরা এই দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে সৌরজগতের বাইরের অংশে কাইপার বেষ্টনীর কিছু বস্তুর অস্বাভাবিক কক্ষপথের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এই বস্তুগুলোর গতিপথ এমনভাবে সাজানো যে, মনে হয় একটি বৃহৎ, অদৃশ্য গ্রহের মহাকর্ষীয় প্রভাব তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। এই তত্ত্বটি কম্পিউটার মডেলিং এবং পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যদিও এখনও এই গ্রহটিকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।

নতুন গ্রহের সম্ভাবনার আলোচনার আগে আমাদের বোঝা দরকার কেন প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। ২০০৬ সালে IAU গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তিনটি শর্ত দিয়েছিল:

বস্তুটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে।
এটি নিজের মহাকর্ষে গোলাকার হবে।
এটি তার কক্ষপথের আশেপাশের অন্যান্য বস্তুকে সরিয়ে দেবে বা নিজের মধ্যে অধিগ্রহণ করবে।

প্লুটো প্রথম দুটি শর্ত পূরণ করলেও তৃতীয় শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, কারণ এটি কাইপার বেষ্টনীর অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে তার কক্ষপথ ভাগ করে। ফলে, প্লুটোকে বামন গ্রহ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়, এবং সৌরজগতের গ্রহের সংখ্যা নয় থেকে আটে নেমে আসে।

নতুন গবেষণায় প্রস্তাবিত “প্ল্যানেট নাইন” এই তৃতীয় শর্ত পূরণ করতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কারণ এটি তার কক্ষপথে অন্যান্য বস্তুর উপর উল্লেখযোগ্য মহাকর্ষীয় প্রভাব ফেলছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্ল্যানেট নাইনের অস্তিত্বের পক্ষে প্রধান প্রমাণ হল কাইপার বেষ্টনীর ছয়টি বস্তুর অস্বাভাবিক কক্ষপথ। এই বস্তুগুলোর কক্ষপথ একই দিকে মিলিত হয় এবং একই তলের উপর অবস্থান করে, যা এলোমেলো হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। গবেষকদের মতে, এই বিন্যাসের জন্য একটি বৃহৎ গ্রহের মহাকর্ষীয় প্রভাব দায়ী হতে পারে।

তবে, এই তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কও কম নয়। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে এই অস্বাভাবিক কক্ষপথগুলো অন্য কোনো কারণে, যেমন সৌরজগতের বাইরের বস্তুর প্রভাব বা অজানা মহাকর্ষীয় শক্তির কারণে হতে পারে। এছাড়া, প্ল্যানেট নাইনকে এখনও সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায়নি, যা এর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ তৈরি করে। বর্তমান টেলিস্কোপগুলোর সীমাবদ্ধতা এবং গ্রহটির সম্ভাব্য দূরত্ব এই পর্যবেক্ষণকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

যদি প্ল্যানেট নাইনের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়, তবে এটি সৌরজগতের গঠন এবং বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে আমূল বদলে দেবে। এই গ্রহটি সৌরজগতের প্রাথমিক পর্যায়ে গঠিত হয়ে থাকতে পারে এবং পরে বাইরের দিকে ছিটকে গিয়ে থাকতে পারে। এটি সৌরজগতের বাইরের অংশে বস্তুগুলোর গতিপথ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া, এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদেরকে আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ তৈরি এবং নতুন পর্যবেক্ষণ কৌশল উদ্ভাবনের জন্য উৎসাহিত করবে।

অন্যদিকে, যদি প্ল্যানেট নাইনের অস্তিত্ব প্রমাণিত না হয়, তবুও এই গবেষণা সৌরজগতের বাইরের অংশ সম্পর্কে নতুন তথ্য প্রকাশ করবে। এটি আমাদেরকে কাইপার বেষ্টনী এবং নেপচুন-উত্তর বস্তুগুলোর গতিশীলতা সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে সাহায্য করবে।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা প্ল্যানেট নাইনের সন্ধানে আরও উন্নত টেলিস্কোপ, যেমন ভেরা সি. রুবিন অবজার্ভেটরি, ব্যবহারের পরিকল্পনা করছেন। এই টেলিস্কোপটি ২০২৫ সালে পুরোপুরি চালু হলে সৌরজগতের দূরবর্তী অংশের আরও বিস্তারিত চিত্র প্রদান করতে পারে। এছাড়া, কম্পিউটার সিমুলেশন এবং নতুন পর্যবেক্ষণ ডেটা ব্যবহার করে গবেষকরা এই গ্রহের সম্ভাব্য অবস্থান নির্ধারণের চেষ্টা করছেন।

সৌরজগতে নবম গ্রহের সম্ভাবনা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি উত্তেজনাপূর্ণ সম্ভাবনা। যদিও এখনও এর অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণিত হয়নি, তবুও এই গবেষণা আমাদের সৌরজগতের জটিল গতিশীলতা এবং অজানা রহস্য সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করছে। আটটি গ্রহ নাকি নয়টি—এই প্রশ্নের উত্তর সময় এবং আরও গবেষণাই দেবে। ততক্ষণ পর্যন্ত, আমরা মহাকাশের এই রহস্যময় গল্পের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য অপেক্ষা করব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button