বিশ্ব আলাপ

চিনের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার

বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে চিন একটি অপরিহার্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তার অর্থনৈতিক শক্তি, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং কৌশলগত কূটনীতি বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক আদর্শই বিশ্বব্যাপী প্রাধান্য পাবে—এমন ধারণা একসময় প্রচলিত ছিল। কিন্তু চিন এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রমাণ করেছে যে, একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক প্রভাব অর্জন সম্ভব। চিনের এই মডেল বিশ্বের অনেক দেশের জন্য একটি বিকল্প পথ হিসেবে উঠে এসেছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে।

চিনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কমিউনিস্ট পার্টির একক নিয়ন্ত্রণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। দেশের অভ্যন্তরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত, এবং রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যাপক। তবুও চিন অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে মুক্তবাজার অর্থনীতি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পথে এগিয়ে গেছে। এই দ্বৈত নীতি—রাজনৈতিক কঠোরতা এবং অর্থনৈতিক নমনীয়তা—চিনকে একটি অনন্য মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ এই মডেলকে তাদের উন্নয়নের জন্য একটি বাস্তবসম্মত পথ হিসেবে বিবেচনা করছে।

চিনের বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার হলো ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI)। এই উদ্যোগের মাধ্যমে চিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে বন্দর, রেলপথ, এবং হাইওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে চিন বাণিজ্যিক সংযোগ জোরদার করছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সুবিধাই নয়, বরং কূটনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব বৃদ্ধিতেও সহায়তা করছে। BRI-এর মাধ্যমে চিন অনেক দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে, যা তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়িয়েছে।

চিন প্রযুক্তি খাতে তার প্রভাব প্রসারিত করছে। হুয়াওয়ের ৫জি নেটওয়ার্ক, টিকটকের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মন জয়, এবং আলিবাবার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম বিশ্বব্যাপী চিনের প্রভাবের বাহক হয়ে উঠেছে। এছাড়া, ‘কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিনা ভাষা ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই সাংস্কৃতিক কূটনীতি চিনের ‘সফট পাওয়ার’ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

চিনের বৈশ্বিক কৌশল রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবর্তে পারস্পরিক স্বার্থ এবং উন্নয়নের ওপর জোর দেয়। পশ্চিমা দেশগুলোর মতো মানবাধিকার বা গণতান্ত্রিক সংস্কারের শর্ত না জুড়ে চিন অনেক দেশের কাছে গ্রহণযোগ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। এই বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি চিনকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছে।

চিনের উত্থান অবশ্য সমালোচনামুক্ত নয়। BRI-এর মাধ্যমে দেওয়া ঋণকে অনেকে ‘ঋণের ফাঁদ’ হিসেবে অভিহিত করছেন, যা দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল করে তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়া, উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতন, হংকংয়ে স্বাধীনতা হরণ এবং তাইওয়ানের ওপর চাপ সৃষ্টির মতো ইস্যু চিনের বৈশ্বিক ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে।

চিন আজ বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, রাজনৈতিক মতাদর্শে পরিবর্তন না এনে কৌশলগত পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক সংযোগ এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার সম্ভব। এই মডেল উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি বিকল্প পথ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের ভূ-রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। চিনের এই উত্থান বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা ক্রমশ বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button