
মঙ্গল গ্রহ। লাল গ্রহ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি আমাদের কল্পনাকে উসকে দিয়েছে। কিন্তু কেন মানুষ মঙ্গলে যেতে চায়? এটা শুধু একটা সায়েন্স ফিকশনের গল্প নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সম্পদ একদিন শেষ হয়ে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যার চাপ, বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের বাধ্য করতে পারে নতুন বাড়ি খুঁজতে। আর মঙ্গল? এটাই আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে কাছের গ্রহ, যেখানে পৃথিবীর মতো কিছুটা পরিবেশ আছে।
মঙ্গলে পানির বরফ পাওয়া গেছে, যা থেকে পানি, অক্সিজেন, এমনকি জ্বালানি তৈরি করা সম্ভব। এর মাটিতে কার্বন ডাই অক্সাইড আছে, যা গ্রিনহাউস তৈরি করে উদ্ভিদ চাষের কাজে লাগতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা, মঙ্গলের দিনের দৈর্ঘ্য পৃথিবীর প্রায় কাছাকাছি—২৪.৬ ঘণ্টা। তাই মঙ্গল হতে পারে আমাদের ‘প্ল্যান বি’। কিন্তু এই স্বপ্নের পথে রয়েছে এক নীরব ঘাতক।
কসমিক রে। এটি হলো উচ্চ-শক্তির কণা, যা সূর্য, সুপারনোভা, বা দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে ছুটে আসে। পৃথিবীতে আমরা নিরাপদ, কারণ আমাদের গ্রহের শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র আর ঘন বায়ুমণ্ডল এই বিকিরণকে বাধা দেয়। কিন্তু মঙ্গলে? সেখানে কোনো চৌম্বকক্ষেত্র নেই, আর বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ১% ঘন। ফলে কসমিক রে সরাসরি মঙ্গলের মাটিতে আঘাত করে।
এই বিকিরণ মানুষের জন্য কতটা বিপজ্জনক? দীর্ঘমেয়াদে কসমিক রে আমাদের শরীরের কোষে মিউটেশন ঘটাতে পারে। এটি ডিএনএ-তে ক্ষতি করে, যার ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। নাসার গবেষণা বলছে, মঙ্গলে এক বছর থাকলে একজন মানুষ পৃথিবীর তুলনায় ১৫ গুণ বেশি বিকিরণের শিকার হতে পারে।
তাহলে কি মঙ্গলে বসতি গড়া অসম্ভব? একদম না! মানুষ কখনোই চ্যালেঞ্জের কাছে হার মানে না। চলুন দেখি, বিজ্ঞানীরা এই সমস্যার সমাধানে কী ভাবছেন।
মঙ্গলে বিকিরণের হাত থেকে বাঁচতে বিজ্ঞানীরা নানা আইডিয়া নিয়ে কাজ করছেন। প্রথম সমাধান: ভূগর্ভস্থ বসতি। মঙ্গলের মাটির নিচে লাভা টিউব বা প্রাকৃতিক গুহা রয়েছে, যেগুলো বিকিরণ থেকে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারে। এই গুহাগুলোতে বসতি গড়লে মানুষ নিরাপদে থাকতে পারবে।
দ্বিতীয় সমাধান: কৃত্রিম চৌম্বকক্ষেত্র। কিছু বিজ্ঞানী প্রস্তাব করেছেন, মঙ্গলের কক্ষপথে শক্তিশালী চুম্বক স্থাপন করা যেতে পারে, যা গ্রহের চারপাশে একটি কৃত্রিম ঢাল তৈরি করবে। এটা এখনও সায়েন্স ফিকশনের মতো শোনালেও, গবেষণা চলছে।
তৃতীয় সমাধান: বিকিরণ-শোষণকারী প্রযুক্তি। উদাহরণস্বরূপ, হাইড্রোজেন-সমৃদ্ধ প্লাস্টিক বা পানির মতো উপাদান দিয়ে তৈরি দেয়াল বিকিরণ বন্ধ করতে পারে। এমনকি মঙ্গলের মাটি থেকে ইট তৈরি করে বাড়ি বানানোর কথাও ভাবা হচ্ছে।
কিন্তু এই সমাধানগুলো এখনও পরীক্ষামূলক। বাস্তবে এগুলো বাস্তবায়ন করতে সময়, অর্থ, আর প্রযুক্তির উন্নতি লাগবে। তবে এটা নিশ্চিত, মানুষ যখন একটা লক্ষ্য ঠিক করে, তখন অসম্ভব বলে কিছু থাকে না।
মঙ্গলের দিকে তাকালে আমরা শুধু একটা নতুন গ্রহই দেখি না, আমরা নিজেদেরও আয়নায় দেখি। মঙ্গলে বেঁচে থাকার চেষ্টা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই পৃথিবীটাই আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। আমাদের গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্র, বায়ুমণ্ডল, আর জীববৈচিত্র্য এমন একটা ভারসাম্য তৈরি করেছে, যা মঙ্গলে পাওয়া এখনও অসম্ভব।
তাই মঙ্গলের স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি আমাদের পৃথিবীকে বাঁচানোর দায়িত্বও নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, আর সম্পদের অপচয় কমিয়ে আমরা পৃথিবীকে আরও দীর্ঘদিন বাসযোগ্য রাখতে পারি। মঙ্গল হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ, কিন্তু পৃথিবী আমাদের বর্তমান।