
মহাবিশ্বের বিশালতায় এমন অনেক গ্রহ রয়েছে, যারা আমাদের কল্পনাকে চ্যালেঞ্জ করে। সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন একটি গ্রহ আবিষ্কার করেছেন, যা তার অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে বিজ্ঞানীদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর নাম BD+05 4868 A। পৃথিবী থেকে ১৪০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই গ্রহটি আমাদের সৌরজগতের বুধ গ্রহের সমান ভর নিয়ে একটি জ্বলন্ত, ক্ষয়প্রাপ্ত জগত। এটি তার হোস্ট নক্ষত্রের এত কাছে ঘুরছে যে, এর পৃষ্ঠ ফুটন্ত ম্যাগমায় ভরে গেছে এবং একটি বিশাল ধ্বংসাবশেষের লেজ সৃষ্টি করছে, যা ধূমকেতুর মতো দেখতে।
BD+05 4868 A তার হোস্ট নক্ষত্রকে এত কাছ থেকে প্রদক্ষিণ করে যে, এটি মাত্র ৩০ ঘণ্টায় একটি পূর্ণ কক্ষপথ সম্পন্ন করে। তুলনা করলে, আমাদের পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন সময় নেয়। এই অতি-সংকুচিত কক্ষপথের কারণে গ্রহটির পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩,০০০°F (প্রায় ১,৬৫০°C) পর্যন্ত পৌঁছে। এই চরম তাপে গ্রহের পৃষ্ঠের শিলা গলে ম্যাগমায় পরিণত হয়, এবং এর কিছু অংশ বাষ্পীভূত হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এই বাষ্পীভূত উপাদানই গ্রহের পিছনে একটি বিশাল লেজ তৈরি করেছে, যা প্রায় ৯০ লক্ষ কিলোমিটার বিস্তৃত—গ্রহের কক্ষপথের অর্ধেক!
এমআইটির প্রধান গবেষক ডঃ মার্ক হোন এবং তার দল প্রথমে এমন কোনো গ্রহ খুঁজছিলেন না। তারা ট্রানজিট পদ্ধতি ব্যবহার করে বহির্গ্রহ সনাক্ত করছিলেন, যেখানে কোনো গ্রহ তার হোস্ট নক্ষত্রের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা সাময়িকভাবে কমে যায়। BD+05 4868 A-এর ক্ষেত্রে, ট্রানজিট সময় অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ এবং প্রতিটি চক্রে সামান্য পরিবর্তিত হচ্ছিল। এই অস্বাভাবিক সংকেতই বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ডঃ হোন ব্যাখ্যা করেন, “এই ট্রানজিটিং আকৃতি একটি লম্বা লেজওয়ালা ধূমকেতুর মতো। তবে, এই লেজে ধূমকেতুর মতো বরফ বা গ্যাস নেই। পরিবর্তে, গ্রহের পৃষ্ঠ থেকে বাষ্পীভূত খনিজ কণা এই লেজ তৈরি করছে।”
BD+05 4868 A-এর কম ভর এবং দুর্বল মহাকর্ষীয় শক্তি এর ক্ষয়ের প্রধান কারণ। এই দুর্বল মহাকর্ষ পৃষ্ঠের উপাদানকে শক্তভাবে ধরে রাখতে পারে না, ফলে উপাদানগুলো বাষ্পীভূত হয়ে মহাকাশে হারিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটি গ্রহটিকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত মাত্র চারটি এমন ক্ষয়প্রাপ্ত গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে, এবং BD+05 4868 A তাদের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের।
এই গ্রহটি বিজ্ঞানীদের জন্য একটি অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে। এটি আমাদের গ্রহ গঠন এবং ধ্বংসের প্রক্রিয়া সম্পর্কে নতুন তথ্য দিতে পারে। এর লেজে থাকা খনিজ কণাগুলো অধ্যয়ন করে বিজ্ঞানীরা গ্রহের গঠন এবং রাসায়নিক উপাদান সম্পর্কে আরও জানতে পারবেন। এছাড়া, এটি নক্ষত্রের কাছাকাছি গ্রহগুলোর জীবনচক্র এবং তাদের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা দেয়।
বিজ্ঞানীরা এখন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মতো উন্নত যন্ত্র ব্যবহার করে BD+05 4868 A-এর লেজ এবং পৃষ্ঠের উপাদান আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে চান। এই গবেষণা গ্রহটির ধ্বংসের হার এবং এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। এমনকি এটি আমাদের সৌরজগতের বাইরে অন্যান্য ক্ষয়প্রাপ্ত গ্রহ খুঁজে পেতে সহায়তা করতে পারে।
BD+05 4868 A আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মহাবিশ্ব কতটা গতিশীল এবং বিস্ময়কর। এই গ্রহটি কেবল একটি জ্বলন্ত শিলা নয়, বরং মহাজাগতিক বিবর্তনের একটি জীবন্ত প্রমাণ। এটি আমাদের প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে—এমন গ্রহে কি কখনো জীবনের সম্ভাবনা ছিল? এবং এই ধরনের গ্রহগুলো কি আমাদের নিজস্ব গ্রহের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলতে পারে?
ছবি: নিজস্ব