
মহাবিশ্বের এক অপূর্ব যাত্রায় আপনাকে স্বাগতম! আজ আমরা ঘুরে দেখবো একটি আকর্ষণীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় ঘটনা—আরপ ১০৭। এটি দুটি মিথস্ক্রিয়াকারী গ্যালাক্সির জোড়া, যা পৃথিবী থেকে প্রায় ৪৬৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে, কোজিশ বা লিও মাইনর তারকামণ্ডলে অবস্থিত।
আরপ ১০৭ কেবল একটি গ্যালাক্সি নয়, এটি একটি মহাজাগতিক টানাটানির মঞ্চ। ১৯৬৬ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হল্টন আরপ তাঁর ‘অ্যাটলাস অফ পেকুলিয়ার গ্যালাক্সিস’-এ এটিকে তালিকাভুক্ত করেন। এই গ্যালাক্সি জোড়াটি তাদের মাধ্যাকর্ষণীয় মিথস্ক্রিয়ার কারণে অস্বাভাবিক গঠন ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে।
চলুন, এই মহাজাগতিক নাটকের দুই নায়কের সঙ্গে পরিচিত হই। প্রথমত, ইউজিসি ৫৯৮৪, একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি, যার বাহুগুলো সংঘর্ষের কারণে বিকৃত ও প্রসারিত হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হলো এমসিজি+০৫-২৬-০২৫, একটি ছোট উপবৃত্তাকার বা অনিয়মিত গ্যালাক্সি। এই দুটি গ্যালাক্সি মাধ্যাকর্ষণের বন্ধনে আবদ্ধ, এবং তাদের মধ্যে গ্যাস, ধূলিকণা ও নক্ষত্রের বিনিময় চলছে।
এই মিথস্ক্রিয়ার ফলে দুটি গ্যালাক্সির মধ্যে একটি মহাজাগতিক ‘সেতু’ তৈরি হয়েছে। এই সেতু গ্যাস ও নক্ষত্র দিয়ে গঠিত, যা দুই গ্যালাক্সিকে যেন একটি অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রেখেছে।
আরপ ১০৭-এর গ্যালাক্সিগুলো এখন সংঘর্ষের একটি মধ্যবর্তী পর্যায়ে রয়েছে। এই সংঘর্ষ নতুন নক্ষত্র গঠনের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে স্পাইরাল গ্যালাক্সির বাহুগুলোতে উজ্জ্বল নক্ষত্র গঠনের অঞ্চল দেখা যায়, যেখানে গ্যাস সংকুচিত হয়ে নতুন নক্ষত্রের জন্ম দিচ্ছে।
মাধ্যাকর্ষণীয় টানের ফলে গ্যালাক্সিগুলো থেকে দীর্ঘ জোয়ারীয় লেজ বা স্ট্রীম তৈরি হয়েছে। এই লেজগুলো গ্যাস, ধূলিকণা ও নক্ষত্র দিয়ে গঠিত, যা আরপ ১০৭-এর অস্বাভাবিক চেহারার জন্য দায়ী।
২০২৪ সালে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ইনফ্রারেড ক্যামেরা আমাদের আরপ ১০৭-এর গভীরতর রূপ দেখিয়েছে। এই ছবিতে দেখা যায় প্রচুর ধূলিকণা ও গ্যাস, যা নতুন নক্ষত্র গঠনের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করছে।
এর আগে, ২০২৩ সালে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ এই গ্যালাক্সি জোড়ার একটি অসাধারণ ছবি তুলেছিল। এই ছবিতে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে সংযোগকারী সেতু এবং তাদের জোয়ারীয় লেজ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, আরপ ১০৭-এর এই দুটি গ্যালাক্সি কয়েক বিলিয়ন বছর পর একীভূত হয়ে একটি বৃহত্তর গ্যালাক্সি তৈরি করবে। এই প্রক্রিয়া মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর বিবর্তনের একটি জীবন্ত উদাহরণ।
এই মিথস্ক্রিয়া আমাদের গ্যালাক্সির গঠন, নক্ষত্র গঠনের হার এবং মাধ্যাকর্ষণীয় গতিবিদ্যা বুঝতে সাহায্য করে। আরপ ১০৭ যেন একটি মহাজাগতিক পরীক্ষাগার, যেখানে আমরা মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করতে পারি।
আরপ ১০৭ শুধু একটি গ্যালাক্সি জোড়া নয়, এটি মহাবিশ্বের বিশালতা ও সৌন্দর্যের একটি প্রতীক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা যতই ছোট হই না কেন, আমরা এই বিশাল মহাজাগতিক নাটকের অংশ।
আরপ ১০৭-এর এই যাত্রা আমাদের মহাবিশ্বের গভীর রহস্যের একটি ঝলক দিয়েছে। এই গ্যালাক্সি জোড়াটি আমাদের শেখায় যে, সংঘর্ষের মধ্যেও সৌন্দর্য ও সৃষ্টি লুকিয়ে থাকে।