
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বর্তমান বিশ্বের প্রযুক্তিগত বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। স্বাস্থ্যসেবা থেকে বিনোদন, শিক্ষা থেকে ব্যবসা—প্রতিটি খাতে AI-এর অগ্রগতি আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ ও গতিশীল করে তুলছে। তবে, এই প্রযুক্তির এক বিশেষ দিক “AI ভিত্তিক এডিকশন” বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিনির্ভর আসক্তি—একটি নতুন বাস্তবতা হয়ে উঠছে, যার ইতিবাচক সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাবও।
ইতিবাচক দিক বিবেচনায়, AI নির্ভর অ্যাপ, গেম, চ্যাটবট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলেছে। AI ব্যবহার করে গড়ে তোলা অ্যালগরিদম প্রতিনিয়ত আমাদের পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট সরবরাহ করছে, ফলে আমরা কম সময়ে বেশি উপযোগী তথ্য পাচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে এটি মানসিক চাপ হ্রাস, একাকীত্ব দূরীকরণ এবং বিষণ্ণতা মোকাবেলায় সহায়ক হয়ে উঠছে। যেমন, একাকী ব্যক্তিরা চ্যাটবটের মাধ্যমে কথা বলার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছুটা সান্ত্বনা পাচ্ছেন, যা সামাজিক সংযোগের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে।
তবে নেতিবাচক দিকটি আরও গভীর এবং চিন্তার বিষয়। AI ভিত্তিক ডিজাইনকৃত প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবহারকারীদের আসক্ত করে তোলে। যেমন, TikTok বা Instagram-এর মতো প্ল্যাটফর্মে অ্যালগরিদম এমনভাবে কনটেন্ট সাজায় যাতে ব্যবহারকারীরা বারবার সেখানে ফিরে আসে এবং সময়ের হিসাব ভুলে যায়। এর ফলে তৈরি হয় “ডুম স্ক্রলিং”, ঘন্টার পর ঘন্টা অর্থহীনভাবে স্ক্রিনে চোখ রেখে থাকার প্রবণতা। শিশুরা গেমিংয়ে এবং প্রাপ্তবয়স্করা সোশ্যাল মিডিয়ায় এতটাই জড়িয়ে পড়ে যে তারা বাস্তব জীবনের দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে শুরু করে। গবেষণায় দেখা গেছে, AI-চালিত প্ল্যাটফর্মে অতিমাত্রায় জড়িত থাকার ফলে মনোযোগের ঘাটতি, নিদ্রাহীনতা, মানসিক অবসাদ এবং আত্মবিশ্বাস হ্রাসের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এর পাশাপাশি, AI ভিত্তিক আসক্তির ফলে তথ্যের বুদবুদে আবদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। ব্যবহারকারীরা নির্দিষ্ট ধরণের কনটেন্ট পেতে পেতে একধরনের একপাক্ষিক চিন্তাধারায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা সামাজিক বিভক্তি বাড়ায় এবং ব্যক্তির বাস্তবতা উপলব্ধির পরিসর সংকুচিত করে।
সুতরাং, AI ভিত্তিক এডিকশন একদিকে যেমন আমাদের জীবনকে সহজ ও বিনোদনমূলক করে তুলছে, অন্যদিকে এটি এক অদৃশ্য কারাগারে আবদ্ধ করে দিচ্ছে, যা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। এই প্রযুক্তির সুফল ভোগ করতে হলে এর প্রতি আমাদের আচরণ হতে হবে সচেতন, সীমাবদ্ধ ও দায়িত্বশীল। প্রযুক্তিকে যেন আমরা ব্যবহার করি, প্রযুক্তি যেন আমাদের ব্যবহার না করে—এই বোধই আমাদের ভবিষ্যৎকে ইতিবাচকভাবে গড়ে তুলতে পারে।