
তখন সবে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে গা-ঝাড়া দিয়ে ফ্রি মুডে দিন কাটাচ্ছি। সকাল-বিকেল কফি শপে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। কখনো কখনো রাত হয়ে যেত বাসায় ফিরতে। যদিও মা টেনশনে থাকতেন, কিন্তু বাড়ির বড়রা কেউ কিছু বলতেন না।
প্রতিদিনের মতোই সেদিনও সকালে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে কফি শপ থেকে বাসায় ফিরছি। হঠাৎ একটি কালো রঙের গাড়ি আমার শরীর ঘেঁষে দাঁড়াল।
— এই শাওন, ভেতরে এসো।
একটা অল্পবয়সী মেয়ে। ওকে আমি চিনি। আমার দুই ক্লাস নিচে পড়ত। পাশের মহল্লার বড় ঘরের মেয়ে। ওর নাম দীঘা।
— কী ব্যাপার, দীঘা?
— ভেতরে এসো।
ও গাড়ির গেট খুলে মেলে ধরে আছে, যেন আমার অপেক্ষায়। আমার খুবই লজ্জা এবং আতঙ্ক লাগছিল। একে তো বড়লোকের মেয়ে, তার উপর ভীষণ রকম সুন্দরী। শুধু আমি না, আমার মতো অনেকেই ওর চালচলন এবং পরিচয় জানার পর ওর আশেপাশে যাওয়ার সাহস পায় না।
আমার ডান হাত ধরে টেনে ওর পাশে সিটে বসাল। ড্রাইভারকে মধ্য শহরের একটি কফি শপের দিকে যেতে বলল দীঘা।
— কী? এর মধ্যে কারো ফাঁদে-টাদে পা দাওনি তো?
ওর প্রশ্ন শুনে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আতঙ্ক তখনো কাটেনি আমার। কী উত্তর দেওয়া উচিত বুঝতে না পারলেও মুখে বললাম, “না দীঘা।”
— উফ্! তোমার কণ্ঠে আমার নামটা শুনে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বহুদিন পরিকল্পনা করেও সাহস পাইনি তোমাকে এভাবে ছিনতাই করতে।
দীঘা কথাগুলো বলেই হেসে উঠল। গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে তখন খুব আস্তে একটা সুন্দর গান বাজছে— ‘আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই’।
আমার ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল। ততক্ষণে গাড়ি এসে থামল মৌটুসি নামের অন্য একটি কফি শপে। দুজনে ভেতরে ঢুকলাম। দীঘা কফির অর্ডার করে এক কোণের একটা টেবিলে আমাকে নিয়ে গেল। অধিকাংশ টেবিলেই কাপলরা জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে।
— শাওন, আজ তোমাকে ছিনতাই করার একটা কারণ আছে। শুনতে চাও সেই কারণ?
আমি গলা পরিষ্কার করে বললাম, “হ্যাঁ দীঘা, বলো।”
— শাওন, আমি তোমাকে বহুদিন থেকেই পছন্দ করি। ইদানীং মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।
— ঠাট্টা করছো, দীঘা?
— না শাওন, মনের কথা বলছি।
— বিশ্বাস করতে বলছো?
— সেটা তোমার ব্যাপার। আমার ভেতর থেকেই কিছুদিন ধরে একটা চাপ অনুভব করছিলাম— যে তোমাকে ভালোবাসি, সেটা তোমাকে সামনাসামনি জানানো উচিত। অনেক সাহস সঞ্চয় করে আজ চাপমুক্ত হলাম। বাকিটা তোমার উপর।
কফি চলে এসেছে। আমি আর কোনো উত্তর দিলাম না। কফিতে দুজনেই চুমুক দিতে দিতে একে অপরকে নীরবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। একসময় কফি শেষ হয়ে গেল।
— আরেক মগ কফি হলে কেমন হয়, শাওন?
— হুম, ভালোই হয়। আরও কিছুক্ষণ দুজন দুজনকে নীরবে দেখতে পারব।
আমাকে হাসতে দেখে দীঘাও মৃদু হেসে উঠল।
— শাওন?
— বলো।
— আমাকে ফিরিয়ে দেবে?
— তোমাকে যে ফিরিয়ে দেবে, সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাধা।
দুজনেই হেসে হেসে গাড়িতে এসে বসলাম। আমার বাসার কাছাকাছি এসে দীঘা আমাকে নামিয়ে দিয়ে বলল, “আমার ফোন নম্বর নেবে না?”
আমি হেসে বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে বললাম, “পছন্দের মানুষের ফোন নম্বর সংগ্রহ করাই থাকে। তোমার ফোন নম্বর আমার মুখস্থ।”
দীঘা সম্ভবত কেঁদে ফেলেছে। চোখ মুছতে মুছতে বলল, “আসি, কাল সকাল ১১টায় মৌটুসিতে অপেক্ষা করব।”
দীঘা চলে যাচ্ছে। যাকে আমি দীর্ঘদিন ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছিলাম, সে-ই আজ নিজে সেই প্রিয় কথাটি বলে গেল।