
পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগে লুকিয়ে থাকা এক বিশাল পানির ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, যা আমাদের পরিচিত সমুদ্র-সাগরের ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ জানায়। এই পানির উৎস কোনো ভূগর্ভস্থ হ্রদ বা তরল পানির বিশাল জলাধার নয়—বরং এটি একধরনের খনিজ পদার্থের ভেতরে আবদ্ধ আণবিক পানি, যা মাটির প্রায় ৭০০ কিলোমিটার নিচে অবস্থিত। এই রহস্যময় খনিজটির নাম রিংউডাইট, যার গঠন কাঠামোর মধ্যেই আটকানো রয়েছে জলীয় অণু। আর সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো, এই পানি ধারণক্ষমতা পৃথিবীর সব পৃষ্ঠের সাগরের পানির তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি।
এই অনন্য আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে একটি গবেষক দলের অভিনব অনুসন্ধান পদ্ধতি। তারা পৃথিবীর গভীর থেকে আসা হাজার হাজার ভূমিকম্পের কম্পন তরঙ্গের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। এই কম্পন তরঙ্গ পৃথিবীর বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে আসার সময় যেভাবে গতি পরিবর্তন করে, সেখান থেকেই বোঝা গেছে কোথাও এমন কিছু বস্তু আছে যেগুলো জলীয় উপাদান ধারণ করতে পারে। বিশ্লেষণে তারা জানতে পারেন, পৃথিবীর ম্যান্টলের ট্রানজিশন জোনে অর্থাৎ ৪১০ থেকে ৬৬০ কিলোমিটার গভীর স্তরে অবস্থিত কিছু খনিজ পাথরের মধ্যে পানি আটকে রয়েছে।
রিংউডাইট নামের এই খনিজটি সচরাচর আমাদের কাছে পরিচিত নয়। এটি সাধারণভাবে পৃথিবীর পৃষ্ঠে পাওয়া যায় না বরং উচ্চচাপ ও উচ্চতাপমাত্রায় ভূগর্ভে সৃষ্টি হয়। এই খনিজের সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হলো এর জলীয় ধারণক্ষমতা। গবেষকরা দেখিয়েছেন, এই রিংউডাইটের মধ্যে ১ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত পানি থাকতে পারে, যা ভূগর্ভস্থ বিশাল অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকলে একটি ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ওশান’-এর সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দেয়।
এই আবিষ্কার কেবল ভূতত্ত্ব নয়, বরং পৃথিবীর পানিচক্র এবং ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস সম্পর্কেও নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। অনেক বিজ্ঞানী এখন মনে করছেন, হয়তো আমাদের পরিচিত মহাসাগরের অনেকটাই আসলে ভূগর্ভস্থ এই পানির মজুদ থেকে উঠে এসেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে পানির গঠন ও বিস্তার বুঝতে এই আন্ডারগ্রাউন্ড ওশান এক নতুন অধ্যায় খুলে দিচ্ছে।
এই সুপ্ত অথচ বিশাল জলাধার শুধু আমাদের গ্রহের গঠনগত রহস্য করেই থেমে থাকছে না, বরং সম্ভাব্য ভবিষ্যতের প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবেও একদিন গুরুত্ব পেতে পারে। যদিও এই পানি আমরা সরাসরি ব্যবহার করতে পারি না, তবে পৃথিবীর অভ্যন্তরের জিওলজিক্যাল প্রক্রিয়ায় এর প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। এমনকি ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত কিংবা টেকটোনিক প্লেটের চলাচল সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞানকে গভীরতর করতে পারে এই আবিষ্কার।
এটি এক অনন্য অনুসন্ধান যা প্রমাণ করে, পৃথিবীর গভীরে এখনও কত রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, যা আমাদের কাছে ধরা দেয়নি। ভূবিজ্ঞান ও মহাজাগতিক গবেষণায় এরকম আবিষ্কার নতুন আলো ছড়ায়, প্রশ্ন তোলে, আবার উত্তর খুঁজে পেতে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের পরিচিত পৃথিবীর নিচে আরও একটি ‘জলময় পৃথিবী’ যে লুকিয়ে আছে, তা ভাবলেই বিস্ময় জাগে—এতদিন কীভাবে তা আমাদের নজর এড়িয়ে গেল!