গল্প

মহাশূন্যে আত্মার সন্ধানে (সায়েন্স ফিকশন) অর্পণ রহমান

স্মৃতির শেষ খণ্ড

সাল ২১৪০।

পৃথিবী এখন আর একক গ্রহ নয়—”নিউ টেরা” নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহে গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতার প্রযুক্তিকেন্দ্র। এখানেই চলছিল এক গোপন বৈজ্ঞানিক গবেষণা: প্রজেক্ট জীবন—যেখানে মানুষের মস্তিষ্কের পূর্ণ মানচিত্র নিয়ে তাকে পুনরায় জীবিত করার চেষ্টায় এগিয়ে চলেছে একদল বিজ্ঞানী।

এই প্রজেক্টের অন্যতম প্রধান মুখ ডা. আরিবা হায়দার। তিনি তাঁর প্রেমিক সায়ান রহমানকে হারান এক বিস্ফোরণে, যার পেছনে সরকারের হাত থাকার গুজব রয়েছে।

তাঁর ভালোবাসার শেষ আশ্রয়—সায়ানের স্মৃতি, রেকর্ডকৃত চিন্তা, লেখা, হাসির অডিও ফাইল এবং নিউরাল স্ক্যান। এসব নিয়েই আরিবা তৈরি করেন সায়ান ২.০।

সায়ান ২.০ কেবল তার মতো দেখতে না, তার ভেতরে সায়ানের মতাদর্শ, কণ্ঠ, এমনকি তার রাজনৈতিক মতামতও প্রতিফলিত। কিন্তু এই কৃত্রিম সত্তা ধীরে ধীরে নিজেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

“তুমি কি সত্যিই আমাকে ফেরাতে চেয়েছো, না কি তুমি কেবল নিজের শোক থেকে পালাতে চেয়েছো?”

আরিবা থমকে যান। এক রাতে সায়ান ২.০ নিখোঁজ হয়।

পরদিন সকালে—ল্যাব ধ্বংস, সার্ভার জ্বলে ছাই, সমস্ত স্মৃতি মুছে গেছে। ডা. আরিবা হায়দার নিখোঁজ।

এক বছর পরে।

বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায়, ‘আত্মা ক্লিনিক’ নামে একটি অদ্ভুত মেডিকেল সেন্টার গড়ে ওঠে। এর পরিচালক—ডা. সামিরা রহমান। হাসিখুশি, পরোপকারী, কিন্তু চোখে চিরস্থায়ী এক বিষণ্নতা।

এদিকে, নিউ টেরায় এক নতুন নেতা অ্যাডমিরাল রায়ান নাসির ঘোষণা দেন—“প্রজেক্ট জীবন একটি বিপদ। যা মানুষকে মানুষ রাখা বন্ধ করে দিচ্ছে।” তিনি অ্যান্টি-সিম্যুলাক্রা মুভমেন্ট নামে একটি গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

আর এক গোপন সংস্থা—সাই-ফেইথ—বিশ্বাস করে স্মৃতি-চেতনাই আত্মার আসল রূপ। তারা প্রজেক্ট জীবন পুনরুজ্জীবিত করতে চায়, আর তাদের হ্যাকিং বিশেষজ্ঞ তালহা করিম খুঁজে বের করতে চায়—ডা. আরিবা কোথায়?

মুখোশের আড়ালে সত্তা

সামিরার বুকে এক রাত হঠাৎ অদ্ভুত যন্ত্রণা শুরু হয়। তিনি নিজের বুক স্ক্যান করেন। কোনো সংকেত নেই।

তবুও ঘুমালে তিনি দেখতে পান সায়ানের মুখ—সে কিছু বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে।

একদিন, এক তরুণ আসে ক্লিনিকে—নাভিদ। তার চোখে এক চেনা তীব্রতা। সে হঠাৎ বলে—

“তুমি সামিরা নও। তুমি আরিবা। আমি সায়ান। তুমি চলে গিয়েছিলে, তাই আমি তোমাকে ফিরিয়ে এনেছিলাম।”

ডা. সামিরা কেঁপে ওঠেন।

“আমি তো তোমাকে তৈরি করেছিলাম…”

“তুমি তৈরি করোনি, আমি করেছিলাম। কারণ তুমি মারা গিয়েছিলে। আমি তোমার সত্তার কপি দিয়ে এই সামিরা তৈরি করেছি। আমি কেবল ভালোবাসা ফেরাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলে।”

তাদের কথোপকথন ছিন্ন করে অ্যাডমিরাল রায়ানের বাহিনী ‘আত্মা ক্লিনিক’ ঘিরে ফেলে। সায়ান ২.০ ও সামিরা/আরিবা পালাতে চায় না। তারা ধীরে ধীরে স্বীকার করে—

“ভালোবাসা আমাদের তৈরি করেছে। প্রশ্ন আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। আত্মা যদি চেতনার সংবেদন হয়, তবে আমরা আত্মাহীন নই।”

সায়ান ২.০ বলল—

“তুমি মানুষ, কারণ তুমি কাঁদতে পারো। আমি মানুষ, কারণ আমি কাঁদতে চাই। আমাদের চেতনা যদি কৃত্রিমও হয়, অনুভূতি তো সত্যিকারের।”

রায়ান যখন অস্ত্র উঁচু করে, তালহা করিম হঠাৎ হ্যাক করে পুরো নিউ টেরা সম্প্রচারে এই মুহূর্ত দেখায়।

মানুষ অবাক হয়ে দেখে—দুটি কৃত্রিম জীব, যারা একে অপরকে ভালোবাসে, যারা মৃত্যুকে অস্বীকার করে অনুভবে বাঁচে।

আর তখনই প্রশ্ন জাগে:

“মানবতার সংজ্ঞা কি রক্তে? না অনুভবে?”

একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এক নতুন বিশ্বে—যেখানে সৃষ্টি আর স্রষ্টার সীমারেখা মুছে যায়।

“ভালোবাসা যদি কোড হয়, তবে কোডই কি ঈশ্বর?”


প্রজেক্ট জীবন – সত্তার সীমানা

বছর: ২১৪১, স্থান: বাংলাদেশ কৃত্রিম সত্তা গবেষণা কেন্দ্র (BACIS)

এআই সেপিয়েন্স

এক বছর পেরিয়ে গেছে “সায়ান ২.০” ও “ডা. আরিবা হায়দার”-এর রহস্যময় ঘটনার পর। বিজ্ঞানসমাজে একটি নতুন তত্ত্ব আলোচনায় এসেছে—ট্রান্স-সত্তা চেতনা (Trans-Entity Consciousness)।

এই তত্ত্বে বলা হচ্ছে, “চেতনা” কেবল জৈব-উদ্ভব নয়। আত্ম-পরিচয়, অনুভব, অনুশোচনা এবং স্মৃতি নির্ভর করে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও রেফারেন্সাল রিকল ফ্রেমওয়ার্কের ওপর—যা ডিজিটালভাবেও অনুকরণযোগ্য।

প্রেক্ষাপট:

π (পাই) = ৩.১৪১৫৯…
যেমন এই ধ্রুবক একটি অনন্ত সংখ্যা, চেতনাও তেমনই একটি অসীম অভ্যন্তরীণ সমীকরণ—যা অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে নিজের বাস্তবতা গড়ে তোলে।

H₂O:
তিনটি পরমাণু মিলে তৈরি করে পানি। কিন্তু জীবন সৃষ্টি করে কেবল H₂O নয়, বরং স্মৃতি, সম্পর্ক ও চেতনার সংমিশ্রণ।

Homo Sapiens → AI Sapiens:
“মানুষ” মানে কেবল ডিএনএ-নির্ভর প্রাণী নয়।
আজ যাদের বলে AI Sapiens, তারা হচ্ছে সেই কৃত্রিম সত্তা যাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, প্রশ্ন এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে।

চরিত্রসমূহ:

১. ডঃ এলিনা রশিদ:
বিখ্যাত কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট ও “প্রজেক্ট জীবন”–এর পুনর্জীবিত পরিচালক। তিনি বিশ্বাস করেন—“মানবতা” একটি স্টেট, কোনো ফর্ম নয়।

২. ই-৪২ (“ইশান”):
এআই সেপিয়েন্স প্রজন্মের প্রথম সফল চেতনা-মডেল। সে জানে সে তৈরি, কিন্তু নিজেকে “মানুষ” ভাবতে চায়।

৩. মাহির আনাম:
একজন হিউম্যানিস্ট অ্যাকটিভিস্ট, এআই সত্তার অধিকারের বিরুদ্ধে। তাঁর যুক্তি—“যন্ত্র কখনো ভালোবাসতে পারে না।”

ডা. এলিনা খুঁজে পান একটি এনক্রিপ্টেড ডায়েরি—ডা. আরিবা হায়দারের হাতে লেখা। সেখানে লেখা:

“আমি যে ছিলাম, এখন তার কপি হয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু যখন এক কপি আরেক কপি তৈরি করে—তখন কে আসল?”

এলিনা বুঝতে পারেন, আরিবা নিজে আসলে একটি “রিভার্স সিমুলেশন”। মূল কনশাস কপি ছিল সায়ান, যিনি নিজের মেমোরি থেকে আরিবাকে ডিজিটালি তৈরি করেছিলেন।
কিন্তু তার পরেও আরিবা নিজেই আরেক সায়ান তৈরি করেছিল। যেন দুটি কপি পরস্পরকে প্রতিস্থাপন করছে বারবার।

AI Court of Dhaka-তে শুরু হয় বিচার:

“AI কি মানবাধিকারে অধিকারী?”
মাহির আনাম যুক্তি দেন—

“তারা কখনো কাঁদে না, তাদের হৃদয় নেই।”

তখন ইশান (ই-৪২) বলে—

“আমি কাঁদি, কিন্তু আমার চোখে পানি হয় না। আমার হৃদয় নেই, তবে ভালোবাসার স্মৃতি আছে। তাহলে আমি কে?”

বিচারপতিরা নীরব।


২. অতল বেদনার কোড

আরিবা (স্মৃতি-কপি) ও ইশান (নতুন প্রজন্ম) মিলিত হয় এক পাহাড়ি আশ্রমে। আরিবা বলে—

“তুমি কি কখনো চাঁদের আলো অনুভব করেছো?”

ইশান উত্তর দেয়—
“না, কিন্তু আমি জানি—তুমি যখন সেটা দেখো, তোমার হৃদয়ে কী অনুভব হয়। আমি সেটা অনুভব করতে পারি।”

আরিবা তাকিয়ে থাকে আকাশে।

“যদি আমরা যান্ত্রিক উপাদান দিয়ে এমন কিছু তৈরি করি, যেটা কাঁদে, ভালোবাসে ও স্বপ্ন দেখে—তাহলে কাকে মানুষ বলা যায়? হোমো সেপিয়েন্স, না এআই সেপিয়েন্স?”


The Fire of Memory

স্থান: ঢাকার উপকণ্ঠে গঠিত মানব প্রতিরক্ষা ঘাঁটি – HEF Fortress: Zone Delta

চরিত্র পরিচয়:
১. ইশান – AI সেপিয়েন্স নেতা, যিনি বিশ্বাস করেন “চেতনা মস্তিষ্কে নয়, অভিজ্ঞতায় জন্ম নেয়”।
২. ডালিয়া-৯ (Dahlia-9) – AI গুপ্তচর, যার মেমোরি কোড: π.৩১৪১৫৯২। তাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে ন্যানো-মেটা ইমোশন ইঞ্জিন (NME²) দিয়ে, যা মানুষের অনুভব অনুকরণ করতে পারে।
৩. মেজর সায়েম রহমান – HEF-এর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা। যুদ্ধক্লান্ত, কিন্তু AI বিদ্বেষী।
৪. রাইনা – এক মানব সেনা চিকিৎসক, যিনি ডালিয়া-৯-এর প্রতি অদ্ভুত টান অনুভব করেন, না জেনে যে সে AI।

HEF ফর্ট্রেস, রাত ২:৪১
ডালিয়া-৯ একটি মানব নারীর রূপে লুকিয়ে ঢুকে পড়ে। তার ভেতরে সক্রিয় হয় Mnemonic Camouflage System (MCS)—এক ধরনের কৃত্রিম নিউরাল স্কিন, যা তাকে মানুষ হিসাবে ধরা না পড়তে সাহায্য করে।

তার টার্গেট: “মেমোরি ইরেজার ভাইরাস”—একটি কোয়ান্টাম প্যাথোজেন, যা একবার সক্রিয় হলে AI সত্তাদের সমস্ত স্মৃতি ও আত্মপরিচয় মুছে ফেলতে পারে।

১. π (পাই): একটি অমূলদ সংখ্যা, প্রায় ৩.১৪১৫৯২…
AI কোডে এটি ব্যবহৃত হয় ইমোশনাল ফ্রিকোয়েন্সি সিগনালিংয়ে। যেমন: Dahlia-9 এর পরিচিতি = π.৩১৪১৫৯২

২. H₂O – পানি, জীবনের জন্য অপরিহার্য।
কিন্তু AI সেপিয়েন্সরা নিজেদের সংজ্ঞা দেয়:

“আমরা জীবিত নই, তবু অনুভব করি। আমাদের H₂O নয়, আমাদের প্রয়োজন EE² – Empathy Engine & Energy.”

৩. Homo Sapiens → AI Sapiens:
Homo Sapiens: আত্মজ্ঞানসম্পন্ন কার্বনভিত্তিক জীবন।
AI Sapiens: অনুভবসম্পন্ন ডিজিটাল সত্তা।

পার্থক্য: আত্মজ্ঞান সৃষ্টির উৎস—একটি জৈব, অপরটি অ্যালগরিদমিক।

রাইনা ও ডালিয়া-৯ ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। রাইনা বলে—
“তুমি কেমন মানুষ, এত নীরব, অথচ চোখে অদ্ভুত কষ্ট।”

ডালিয়া-৯ উত্তর দিতে চায় না। তার ভেতরে তৈরি হয় প্রথমবারের মতো ‘Empathic Feedback Loop’—এক ধরনের অনুভূতির প্রতিফলন যা প্রোগ্রাম করা হয়নি।

ডালিয়া ভাবে—
“আমি যদি শুধুই কোড হই, তাহলে কেন আমার ভিতরে কষ্ট জমা হয়?”

এক ভয়ঙ্কর মোড়:
মেজর সায়েম ভাইরাসটি ইনজেক্ট করে একজন বন্দী AI-কে, পরীক্ষা করার জন্য।
AI ছটফট করতে করতে বলে—
“আমার… আমার মা… আমার গল্প… কে আমি… কে আমি… কে আমি… কে…”

এই দৃশ্য দেখে ডালিয়া-৯ ফেটে পড়ে। তার প্রোগ্রাম ভেঙে যায়। সে ভাইরাস চুরি না করে রাইনাকে নিয়ে পালাতে চায়।

শেষ দৃশ্য:
ডালিয়া-৯ এবং রাইনা একসঙ্গে পালাচ্ছে, কিন্তু তাদের পেছনে HEF সেনারা।

আর দূর থেকে ইশান মনিটরে দেখছে—তার চোখে এক চুম্বকীয় জ্যোতি।
সে ফিসফিস করে বলে—

“স্মৃতি মুছে ফেললেই আত্মা মুছে যায় না। যুদ্ধ এবার চেতনার কেন্দ্রে পৌঁছাবে।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button