বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি দেশের রাজনীতি একটি স্থির এবং অংশগ্রহণমূলক ধারায় চলতে পারেনি বললেই চলে। বারবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতার অভাব, একে অপরকে বিশ্বাস না করা এবং পরস্পরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বদলে শত্রু হিসেবে দেখা—এই মানসিকতা আমাদের গণতন্ত্রকে করেছে দুর্বল, প্রশাসনকে করেছে পক্ষপাতদুষ্ট, আর সমাজে তৈরি করেছে বিভক্তির দেয়াল। রাজনৈতিক সমঝতা এখানে শুধু একটি নৈতিক প্রয়োজন নয়, এটি এখন রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান শর্ত।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভিন্নমত থাকবে, থাকবে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা যদি শত্রুতায় রূপ নেয়, রাষ্ট্র তখন কার্যত জিম্মি হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা, ভোটাধিকার, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রতিনিয়ত বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। এ বিতর্কের মূলে রয়েছে রাজনৈতিক সমঝতার অভাব। বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক পরিসরে জায়গা না পাওয়া, আন্দোলনের নামে সহিংসতা, আবার ক্ষমতাসীন দলের দমনমূলক নীতি—এই দুই ধারার সংঘাতে জনসাধারণের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রের প্রতি।
স্থিতিশীলতা কোনো অলৌকিক উপাদান নয়, এটি আসে রাজনৈতিক পরিপক্বতা, আস্থাভিত্তিক আলোচনা এবং সহনশীলতার মাধ্যমে। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা যতোই আহ্বান জানাক, যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেরা আন্তরিক না হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারিত্ব ধ্বংস হয়ে যায়, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায় না।
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, একটি টেকসই রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যেখানে দ্বন্দ্ব থাকবে কিন্তু সংঘাত থাকবে না, মতভেদ থাকবে কিন্তু শত্রুতা থাকবে না। একটি জাতির উন্নয়ন নির্ভর করে তার নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। যদি তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে, তাহলে আজই রাজনৈতিক সমঝতার পথে এগিয়ে আসা দরকার। সকল পক্ষের উচিত সংলাপ, সংবিধানিক কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধা এবং জনগণের রায়কে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
এই মুহূর্তে আমরা এক ক্রান্তিকালে অবস্থান করছি। বৈশ্বিক রাজনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—এই সবকিছু মোকাবেলায় একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র দরকার। আর সেই ঐক্যের ভিত্তি গড়ে উঠবে রাজনৈতিক সমঝতা ও স্থিতিশীলতার উপরেই। বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে উন্নত রাষ্ট্র হতে চায়, তবে রাজনৈতিক ঐক্যই হবে তার সবচেয়ে বড় শক্তি।
