
চাঁদ, পৃথিবীর প্রাকৃতিক উপগ্রহ, সৌরজগতের একটি রহস্যময় সদস্য। এর উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি চীনের ছাং’এ-৬ মিশনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা নমুনার গবেষণায় একটি যুগান্তকারী তথ্য উঠে এসেছে: চাঁদের জন্মের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি সম্পূর্ণ গলিত ম্যাগমায় পরিপূর্ণ ছিল। এই আবিষ্কার চাঁদের ম্যাগমা মহাসাগর তত্ত্বকে সমর্থন করে এবং এর উৎপত্তি ও বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
চীনা সংবাদমাধ্যম সিএমজি ও সিসিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসন (সিএনএসএ) পরিচালিত ছাং’এ-৬ মিশন প্রথমবারের মতো চাঁদের দূরবর্তী পাশ (ফার সাইড) থেকে ১,৯৩৫.৩ গ্রাম নমুনা সংগ্রহ করে। এই নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষকরা জানতে পেরেছেন যে, চাঁদের কাছের পাশ (নিয়ার সাইড) এবং দূরবর্তী পাশের আগ্নেয় শিলা (বেসাল্ট) একই ধরনের। এই নমুনাগুলোতে ২৮২ কোটি ৩০ লাখ বছরের পুরনো ম্যাগমার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই তথ্য চাঁদের প্রাথমিক পর্যায়ে একটি বিশাল গলিত ম্যাগমা মহাসাগরের অস্তিত্বের তত্ত্বকে আরও শক্তিশালী করেছে।
চাইনিজ একাডেমি অফ জিওলজিক্যাল সায়েন্সেস-এর গবেষক ছ্য সিয়াওছাও জানান, “প্রথমবারের মতো চাঁদের দূরবর্তী পাশ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে আদিকালে চাঁদের পুরো পৃষ্ঠ একটি বিশাল ম্যাগমা মহাসাগরে পরিপূর্ণ ছিল।” এই গবেষণার ফলাফল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
ম্যাগমা মহাসাগর তত্ত্ব অনুসারে, চাঁদের জন্মের পর এটির পৃষ্ঠ তরল গলিত শিলা বা ম্যাগমায় আচ্ছাদিত ছিল। এই তরল ম্যাগমা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে শক্ত পাথরে রূপান্তরিত হয়, যা থেকে চাঁদের বর্তমান ভূত্বক গঠিত হয়েছে। ছাং’এ-৬ মিশনের নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চাঁদের দুই পাশের আগ্নেয় শিলার গঠন ও বয়সে উল্লেখযোগ্য মিল রয়েছে, যা এই তত্ত্বের পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ।
ছাং’এ-৬ মিশনের এই সাফল্য শুধু চাঁদের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে নতুন তথ্যই প্রদান করেনি, বরং চাঁদের উৎপত্তি ও বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। চাঁদের দূরবর্তী পাশ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা একটি জটিল ও চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল, কারণ এই অংশ পৃথিবী থেকে সরাসরি দৃশ্যমান নয় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা কঠিন। তবুও চীনের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এই মিশনকে সফল করেছে।
এই আবিষ্কার চাঁদের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের পাশাপাশি সৌরজগতের গঠন ও বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই নমুনাগুলোর আরও বিশ্লেষণ ভবিষ্যতে চাঁদের উৎপত্তি সম্পর্কে আরও নতুন তথ্য প্রকাশ করতে পারে। চীনের এই মিশন মহাকাশ গবেষণায় একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ মিশনের জন্য পথ দেখাবে।
চাঁদের রহস্য উন্মোচনে ছাং’এ-৬ মিশনের এই অর্জন একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এটি শুধু চীনের মহাকাশ গবেষণার ক্ষমতাই প্রদর্শন করেনি, বরং বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন গবেষণার দ্বার উন্মোচন করেছে। চাঁদের ম্যাগমা মহাসাগরের এই প্রমাণ আমাদের মহাজাগতিক প্রতিবেশী সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার সুযোগ করে দিয়েছে।