জ্যোতির্বিজ্ঞান

বাইনারি স্টার সিস্টেম: মহাবিশ্বের এক রোমাঞ্চকর খেলা

মহাবিশ্বের বিশালতায়, যেখানে নক্ষত্ররা নিজেদের আলো নিয়ে একাকী জ্বলতে দেখা যায়, সেখানে কিছু নক্ষত্র জোড়ায় জোড়ায় নাচে, একে অপরের সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণের বন্ধনে আবদ্ধ। এরা হলো বাইনারি স্টার সিস্টেম বা দ্বৈত নক্ষত্র ব্যবস্থা—মহাকাশের এক রোমাঞ্চকর নৃত্য, যা বিজ্ঞানীদের কাছে শুধু সৌন্দর্যই নয়, মহাবিশ্বের গোপন রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠিও।

বাইনারি স্টার সিস্টেম হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে দুটি নক্ষত্র একটি সাধারণ ভরকেন্দ্রের চারপাশে পরস্পরের সঙ্গে কক্ষপথে ঘুরে। এই নক্ষত্র দুটি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। এদের মধ্যে কখনো দুটি নক্ষত্রই সমান ভরের হয়, আবার কখনো একটি বড় এবং অপরটি ছোট হতে পারে। এই বৈচিত্র্যই বাইনারি সিস্টেমকে এত আকর্ষণীয় করে তোলে।
মজার ব্যাপার হলো, আমাদের আকাশে যেসব নক্ষত্রকে আমরা একটি বিন্দু হিসেবে দেখি, তাদের মধ্যে অনেকগুলোই আসলে বাইনারি সিস্টেম। উদাহরণস্বরূপ, আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র সিরিয়াস (Sirius) আসলে একটি বাইনারি সিস্টেম, যার মধ্যে সিরিয়াস এ এবং সিরিয়াস বি নামে দুটি নক্ষত্র রয়েছে।

বাইনারি স্টার সিস্টেমকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন:

ভিজুয়াল বাইনারি: এই ধরনের সিস্টেমে দুটি নক্ষত্রই টেলিস্কোপের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এরা একে অপরের চারপাশে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে, এবং তাদের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা তাদের ভর এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে পারেন।

স্পেকট্রোস্কোপিক বাইনারি: এই নক্ষত্রগুলো এত কাছাকাছি থাকে যে টেলিস্কোপে এদের আলাদা করে দেখা সম্ভব হয় না। তবে, তাদের আলোর স্পেকট্রাম বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে এটি একটি দ্বৈত ব্যবস্থা। এদের গতি ডপলার প্রভাবের মাধ্যমে সনাক্ত করা যায়।

ইক্লিপসিং বাইনারি: এই সিস্টেমে দুটি নক্ষত্র এমনভাবে কক্ষপথে ঘুরে যে কখনো একটি অপরটির সামনে চলে আসে, ফলে পৃথিবী থেকে তাদের উজ্জ্বলতা কমে যায়। এই উজ্জ্বলতার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা তাদের আকার, ভর এবং কক্ষপথ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। উদাহরণস্বরূপ, অ্যালগোল (Algol) একটি বিখ্যাত ইক্লিপসিং বাইনারি।

অ্যাস্ট্রোমেট্রিক বাইনারি: এখানে একটি নক্ষত্র দৃশ্যমান, কিন্তু তার গতিপথে সামান্য অনিয়ম দেখে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে এটি একটি অদৃশ্য সঙ্গীর সঙ্গে কক্ষপথে ঘুরছে। এই অদৃশ্য সঙ্গী হতে পারে একটি ছোট নক্ষত্র বা এমনকি একটি ব্ল্যাক হোল।

বাইনারি স্টার সিস্টেম শুধু সৌন্দর্যের জন্যই নয়, এরা মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞান বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রের ভর, আকার, ঘনত্ব এবং বিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, নক্ষত্রের ভর নির্ণয়ের জন্য বাইনারি সিস্টেম একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। এছাড়া, এই সিস্টেমগুলো সুপারনোভা বিস্ফোরণ, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ এবং এমনকি ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব প্রমাণে সহায়ক।
কিছু বাইনারি সিস্টেমে, যেমন কাছাকাছি দুটি নক্ষত্রের মধ্যে পদার্থ স্থানান্তর ঘটে। এই প্রক্রিয়া অ্যাক্রিশন ডিস্ক তৈরি করতে পারে, যা থেকে প্রচণ্ড শক্তি নির্গত হয়। এই ধরনের ঘটনা আমাদেরকে এক্স-রে বাইনারি বা নোভার মতো ঘটনা পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেয়।

বাইনারি স্টার সিস্টেমকে মহাকাশের একটি নৃত্য হিসেবে কল্পনা করা যায়, যেখানে দুটি নক্ষত্র একে অপরের সঙ্গে সুরেলা ভাবে ঘুরছে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button