
রাতের আকাশে তাকিয়ে কেউ যদি একটিমাত্র উজ্জ্বল, কমলা-লালচে রঙের তারাকে দেখতে পান, তবে অনেকটাই সম্ভাবনা থাকে যে তিনি দেখছেন আর্কটুরাসকে। এই মহা উজ্জ্বল নক্ষত্রটি আমাদের সৌরজগতের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন মাত্রার এক জগতে অবস্থান করে। আর্কটুরাস (Arcturus) হলো ষাঁড়তারার (Boötes) নক্ষত্রমণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং রাতের আকাশে এটি চতুর্থ উজ্জ্বলতম। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৬.৭ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং এটি একটি লাল দানব নক্ষত্র (Red Giant)। আর্কটুরাস সূর্যের তুলনায় প্রায় ২৫ গুণ বেশি উজ্জ্বল এবং আকারে প্রায় ২৫ গুণ বড়। সূর্য যেখানে এখনও প্রধান ক্রমের (Main Sequence) একটি তরুণ নক্ষত্র, আর্কটুরাস সেখানে ইতোমধ্যেই তার কেন্দ্রের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলেছে এবং এখন এটি হিলিয়াম গলানোর ধাপে প্রবেশ করেছে। তার এই বিকশিত রূপের কারণেই সে লাল রঙের এবং এত বিশাল ও উজ্জ্বল।
আর্কটুরাসকে ঘিরে একাধিক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক কৌতূহল রয়েছে। একে কখনো কখনো “ভবিষ্যতের সূর্য” হিসেবেও অভিহিত করা হয়, কারণ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আজ থেকে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বছর পর সূর্যও আর্কটুরাসের মতো একটি লাল দানবে রূপান্তরিত হবে। এটি আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ের ডিস্ক অংশে সাধারণ নক্ষত্রদের মতো আবর্তিত হচ্ছে না; বরং তা এক অনন্য গতিপথে চলছে, যা অনেক গবেষকের মতে, মিল্কিওয়ের সঙ্গে একসময় ধাক্কা খাওয়া ছোট কোনো বামন গ্যালাক্সির অংশ হতে পারে। এই গতি এবং গতিপথের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যই এটিকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
আর্কটুরাসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিকভাবেও গুরুত্ববাহী। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় এর নামের উৎপত্তি – “Arktouros” – যার অর্থ “ভালুকের রক্ষক”, কারণ এটি উরসা মেজর (Great Bear) তারামণ্ডলের কাছাকাছি অবস্থান করছে বলে মনে করা হয়। হাওয়াই এবং মাওরি সংস্কৃতিতেও এর রয়েছে আলাদা পরিচিতি। আধুনিক সময়ে, ১৯৩৩ সালের শিকাগো ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে আর্কটুরাস থেকে আগত আলোকরশ্মিকে প্রদর্শন অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে ব্যবহার করা হয়েছিল, কারণ ধারণা করা হয়, আর্কটুরাস থেকে আসা আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় নিয়েছিল সেই প্রথম বিশ্ব মেলার পর থেকে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, আর্কটুরাসের চারপাশে গ্রহের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ এটি এখন তার জীবনচক্রের এমন এক ধাপে রয়েছে যেখানে পূর্বে যদি কোনো গ্রহ থেকেও থাকে, তারা হয়তো ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে বা কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তবু এটি ঘিরে রোমাঞ্চ ও গবেষণার আগ্রহ থেমে নেই। এই উজ্জ্বল লাল দানব যেন আমাদের সৌরজগতের ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি হয়ে আকাশে জ্বলছে, এক মহাজাগতিক বার্তা বহন করে – যে সবকিছুই বদলায়, এমনকি নক্ষত্ররাও।