
১৯৭০ সালের মে মাস। স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা তুঙ্গে। মহাকাশ জয়ের দৌড়ে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। কিন্তু মহাকাশের বাইরে আরেকটি সীমান্তে নজর দিয়েছিল সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা—পৃথিবীর গভীরে। রাশিয়ার কোলা উপদ্বীপে, মুরমানস্কের কাছে, শুরু হয় একটি অভূতপূর্ব প্রকল্প: কোলা সুপারডিপ বোরহোল। এটি ছিল পৃথিবীর ভূত্বক ভেদ করে গভীরতম কৃত্রিম গর্ত খননের একটি সাহসী পরিকল্পনা। কিন্তু এই প্রকল্প শুধু বিজ্ঞানের গল্প নয়, এটি রহস্য, গুজব এবং মানুষের কল্পনার এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য ছিল মোহো ডিসকন্টিনিউটি (Moho) নামক ভূতাত্ত্বিক সীমানা স্পর্শ করা, যেখানে পৃথিবীর ভূত্বক ম্যান্টেলের সঙ্গে মিলিত হয়। এটি ছিল বিজ্ঞানের জন্য একটি বিশাল পদক্ষেপ। মহাকাশে পৌঁছানোর মতোই পৃথিবীর গভীরে প্রবেশের এই প্রকল্প ছিল স্নায়ুযুদ্ধের আরেকটি প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই যাত্রা শুরু থেকেই চ্যালেঞ্জে ভরা ছিল।
খনন শুরু হয় কোলা উপদ্বীপের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বিজ্ঞানীরা বিশেষ ড্রিলিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, যা পৃথিবীর শক্ত শিলা ভেদ করতে সক্ষম। বছরের পর বছর ধরে তারা গভীরে নামতে থাকেন। ১৯৮৯ সাল নাগাদ তারা ১২,২৬২ মিটার গভীরতায় পৌঁছে যান—পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর কৃত্রিম গর্ত। এটি ছিল এভারেস্টের উচ্চতার দেড় গুণেরও বেশি। কিন্তু এই গভীরতায় পৌঁছানোর পর যা আবিষ্কৃত হয়, তা বিজ্ঞানীদের অবাক করে দেয়।
১২,২৬২ মিটার গভীরে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু পান, যা তাদের প্রত্যাশার বাইরে ছিল। প্রথমত, তারা আবিষ্কার করেন জল। ভূত্বকের এত গভীরে জলের অস্তিত্ব তৎকালীন বিজ্ঞানীদের কাছে অকল্পনীয় ছিল। এই জল ছিল প্রাচীন, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে শিলার মধ্যে আটকে থাকা। এটি পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে নতুন ধারণা দেয়।
দ্বিতীয়ত, তারা পান জীবনের চিহ্ন। ২.৭ বিলিয়ন বছর পুরনো শিলায় মিথেন ও জৈব অণুর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এটি ছিল বিস্ময়কর, কারণ এত গভীরে জীবনের অস্তিত্ব অসম্ভব বলে মনে করা হত। এই আবিষ্কার জীববিজ্ঞান ও ভূতত্ত্বের সীমানা প্রসারিত করে।
তৃতীয়ত, তাপমাত্রা। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, এই গভীরতায় তাপমাত্রা হবে প্রায় ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই অতিরিক্ত তাপে ড্রিলিং সরঞ্জাম গলে যাওয়ার উপক্রম হয়। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এখানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৯২ সালে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। অর্থনৈতিক সংকট, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং অসহনীয় তাপমাত্রার কারণে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। কিন্তু এই গর্তটি শুধু বিজ্ঞানের গল্প নিয়ে থেমে থাকেনি। এরপরই জন্ম নেয় একের পর এক অদ্ভুত গুজব।
সবচেয়ে বিখ্যাত গুজব ছিল ‘নরকের চিৎকার’। গল্প ছড়ায় যে, বিজ্ঞানীরা গর্তে মাইক্রোফোন নামিয়ে অমানুষিক চিৎকার শুনেছেন, যেন নরক থেকে শয়তানের কণ্ঠ ভেসে আসছে। এই গল্প ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। পরে প্রমাণিত হয় এটি ছিল একটি হোয়াক্স, সম্ভবত ধর্মীয় প্রচারণার অংশ। কিন্তু এই গল্প মানুষের কল্পনাকে উসকে দেয়।
আরেকটি গুজব ছিল ‘কালো পাখি’র। বলা হয়, গর্ত থেকে একটি রহস্যময় কালো প্রাণী উড়ে বেরিয়ে আসে, যা বিজ্ঞানীরা ধরতে পারেননি। কেউ বলেন, এটি ছিল এলিয়েন, কেউ বলেন অতিপ্রাকৃত কিছু। এই গল্পের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও, এটি কোলা বোরহোলের রহস্যময়তা আরও বাড়িয়ে দেয়।
কেউ কেউ দাবি করেন, এই প্রকল্প আসলে সামরিক গোপন গবেষণার অংশ ছিল। এলিয়েন প্রযুক্তি বা অজানা শক্তির উৎস খুঁজে বের করাই ছিল এর আসল উদ্দেশ্য। যদিও এই তত্ত্বগুলোর কোনো প্রমাণ নেই, তবু এগুলো জনমনে কৌতূহল জাগিয়েছে।
আজ কোলা সুপারডিপ বোরহোল পরিত্যক্ত। গর্তটি সিল করে দেওয়া হয়েছে, এবং এটির চারপাশে শুধু ধ্বংসাবশেষ আর মরিচা পড়া যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। তবু এই গর্তটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এটি আমাদের দেখিয়েছে যে, পৃথিবীর গভীর কতটা অজানা এবং অপ্রত্যাশিত।
এই প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য ভূতত্ত্ব ও জীববিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত খুলেছে। এটি প্রমাণ করেছে যে, পৃথিবীর গভীরে জীবন সম্ভব, এমনকি এমন পরিবেশেও যা আমরা অকল্পনীয় মনে করি। তবে এটি আমাদের শিখিয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ: বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই হয়তো আমাদের সবচেয়ে বড় রহস্য।
কোলা বোরহোল বন্ধ হয়ে গেলেও, পৃথিবীর গভীরে যাওয়ার স্বপ্ন এখনও জীবিত। চীন ও জাপান নতুন প্রযুক্তি নিয়ে গভীর খননের পরিকল্পনা করছে। তারা আশা করছে আরও উন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে মোহো সীমানায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—আমরা কি সত্যিই পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছাতে প্রস্তুত? নাকি গভীরে আরও রহস্য লুকিয়ে আছে, যা আমাদের কল্পনার বাইরে?
কোলা সুপারডিপ বোরহোল শুধু একটি গর্ত নয়। এটি মানুষের কৌতূহল, সাহস এবং সীমাবদ্ধতার প্রতীক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা যতই এগিয়ে যাই, পৃথিবী আমাদের জন্য নতুন রহস্য উন্মোচন করবে। হয়তো একদিন আমরা পৃথিবীর গভীরতম স্তরে পৌঁছাব, কিন্তু আজও এটি একটি রোমাঞ্চকর স্বপ্ন।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া/DD