
হরিপদ বড় একা। এই একাকিত্ব একটা অভ্যাস। বড় খারাপ অভ্যাস।
একাকিত্বের অভ্যাস, এক ঘর মানুষের মাঝেও যেন তাকে একঘরে করে দেয়। বারবার ওর মনে হয়, কখন নিজের ঘরটায়, চেনা পরিবেশে ফিরে যাবে।
নিজের ঘরে, চেনা বিছানা, চেয়ার, টেবিল, সোফা, বাসনকোসন — এসবের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাবে। চেনা পরিবেশে ওর ভাবনারা ডানা মেলে। যত লেখে ডায়েরি পাতায়, মনের খাতায় লেখা রয়েছে তার অনেক অনেক গুণ বেশি।
সারাক্ষণ একা থাকার জন্য মানসিক জোর লাগে, এটা ঠিক না। আসলে তার আশপাশের মানুষগুলো, সময়ের স্রোতে, কখন যে এক এক করে সরে পড়েছে পরিবারের সদস্যরা, হরিপদরা তা বুঝে উঠতে পারেনি।
মানুষ সবার সাথে মিলেমিশে থাকবে, আদিম কাল থেকে এ নিয়ম চলে আসছে। শুধু মানুষ নয়, প্রাণীকূলের মধ্যে এই নিয়ম আজও রয়েছে।
অরণ্যচারী মানুষ, বিবর্তনের সবচেয়ে বড় ধারক। অন্য প্রাণীদের চাইতে দো-পায়া এই প্রাণীরা ভীষণ আত্মসুখীও বটে। এই আত্মসুখের কারণে এরা কখন যে একান্নবর্তী পরিবারের গণ্ডি ভেঙে একান্ন পরিবার হয়ে গেছে ঠাহর করা যায়নি। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, অণু পরিবার থেকে পরমাণু পরিবার।
ঠিক ঠিক ঠিক।
নিজের অজান্তে কপালে হাত ঠেকায় হরিপদ। অণু পরিবারে তার একমাত্র সঙ্গী টিকটিকিটা। কোথায় যে থাকে, বুঝতে পারে না হরিপদ। যখন ভাবনার মাঝে ওর ‘টিক টিক টিক’ বার্তা আসে, হরিপদর মনে হয়, একজন সাপোর্টার পাওয়া গেছে।
একা থাকলেও মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজনে কোনো ছাড় নেই। তাই প্রয়োজনের তাগিদে মাঝে মাঝে বাইরে বের হতে হয় হরিপদকে।
নিজের রান্না নিজেই করে হরিপদ। মনে মনে ভাবে, “পরের জায়গা, পরের জমি, ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি’ত ভাই ঘরের মালিক নই।” ভাবনায় দেহতত্ত্ব এলেও, দেহ তার দাবি আদায় করতে ছাড়ে না। তাই কাঁচাবাজার, নটকনের দোকান (মুদিখানা) থেকে প্রয়োজনীয় তেল, মশলা সবই কিনতে হয় রান্নাবান্নার জন্য। পাশাপাশি আছে ওষুধের দোকান ও লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পাল্টে আনা।
তবে ওষুধ ও বই পাল্টে আনার কাজটি হরিপদ বিকেলে করে। লাইব্রেরিটা খোলেই অপরাহ্নে। লাইব্রেরির রিডিং রুমে বসে নিউজপেপারগুলো উল্টেপাল্টে দেখে।
লাইব্রেরির রিডিং রুমে, দু-চারজন চেনা মুখ রোজ ঘুরেফিরে আসে। তাদের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বা এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করতে গিয়ে দেখেছে, প্রত্যাশা মতো আগ্রহ নিয়ে তাঁরা কিছু শোনেন না। এসব নিয়ে এখন আর হরিপদর মন খারাপ হয় না। আসলে প্রত্যাশা শব্দটাই মুছে গেছে মনের অভিধান থেকে।
সন্ধ্যার পরে বাইরে কাজ করা ওর ভালো লাগে না। বাইরের কাজ থাকলে, ও দিনের যেকোনো সময় বেরিয়ে, কাজ সেরে আসে। যখনই ও বাইরের কাজ সেরে, দরজা খুলে ঘরে ঢোকে, ও টিকটিকিটাকে দেখতে পায়, দেয়ালে জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। ওকে দেখেই কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। হরিপদ ভাবে, টিকটিকিটাও কি ঘরের মধ্যে হরিপদের না থাকাটা বা ওর নিজের একা থাকাটা উপভোগ করে?
রাতেও এমন প্রায়ই হয় যে ঘুম আসছে না, নানান বিষয় নিয়ে ভাবছে, টিকটিকিটা টিক টিক করে ওঠে। দিন-রাত ওর ভাবনার শরিক শুধু না, রীতিমতো সমর্থক হয়ে পাশে থাকে।
বেড সুইচ অন করলেই দেখতে পায়, টিকটিকিটা ক্যালেন্ডারের আড়ালে কি দেয়াল ঘড়ির পেছনে লুকিয়ে পড়ে। নিস্তব্ধ রাতে দেয়াল ঘড়ির টিক টিক আওয়াজ যেন সানাইয়ের পো ধরার মতো টিকটিকির সুরটি ধরে রেখেছে।
পত্রিকার সম্পাদক মহাশয়কে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই। পত্রিকার বিন্যাস, সম্পদনা ও বিষয় বিভাজন অসাধারণ।