
কখনো গভীর রাতে একা বসে আপনি কি নিজেকে শুধিয়েছেন—এই মাথার ভেতরে কেমন যেন একটা রহস্যময় আলো জ্বলে? হয়তো আপনি সেটাকে অনুভব করেননি, কিন্তু বিজ্ঞানের নিরিখে, আপনার খুলির ভেতরে সত্যিই আছে এক অনবরত আলো জ্বালানো ‘পাওয়ার স্টেশন’। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, আমাদের এই জৈবিক যন্ত্রটি প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে—ঠিক এতটাই, যেটা দিয়ে জ্বালানো যায় একটি ছোট এলইডি বাল্ব!
প্রায় দেড় কেজি ওজনের এই নরম পিচ্ছিল বস্তুটি শুধু চিন্তা বা স্মৃতি নয়, আপনাকে আলোয় রাখার মতো শক্তিও তৈরি করে। আমাদের মস্তিষ্কে আছে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন, প্রতিটি যেন সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক তারের মতো কাজ করে। এরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলে বৈদ্যুতিক সংকেত বা ইলেকট্রিক্যাল ইমপালস-এর মাধ্যমে। নিউরনের কোষপ্রাচীরে থাকা সোডিয়াম-পটাশিয়াম আয়নের নাচানাচিই সেখানে তৈরি করে ক্ষুদ্র এক বিদ্যুৎঝলক, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় “অ্যাকশন পটেনশিয়াল”।
একটি নিউরনের উৎপন্ন বিদ্যুৎ খুবই ক্ষুদ্র—মাত্র ৭০ মিলিভোল্ট, কিন্তু কল্পনা করুন, ৮৬ বিলিয়ন নিউরন একসাথে যখন কাজ করে, তখন মানবমস্তিষ্ক প্রায় ২০ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়! এই শক্তি যথেষ্ট একটি LED বাতি জ্বালানোর জন্য, যা আপনার তীক্ষ্ণ ভাবনা বা স্মৃতির মতো ক্ষীণ অথচ স্থায়ীভাবে দীপ্তিময়।
এই বিদ্যুৎ শুধু কল্পনার বিষয় নয়। EEG বা ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম নামের পরীক্ষায় আমরা মাথার ত্বকে ইলেকট্রোড বসিয়ে মাপি এই বিদ্যুৎপ্রবাহ, যা ব্যবহার হয় মৃগীরোগ, ঘুমের সমস্যা বা নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার চিহ্নিত করতে।
বিশ্বের সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের Wu Tsai Neurosciences Institute, এই মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সংকেতকে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিতে রূপান্তর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভাবুন তো, এমন এক পৃথিবীর কথা, যেখানে আপনি চিন্তা করলেই আপনার কৃত্রিম হাত ওঠে, চোখে দেখলেই মেশিনে ডেটা পাঠায়—এটা আর কল্পনা নয়, এটা বাস্তব হয়ে উঠছে ‘ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস’ নামক গবেষণার মাধ্যমে।
তাই, যেদিন আপনি নিজেকে খুব সাধারণ মনে করবেন, ভুলবেন না—আপনার মাথার ভেতরে জ্বলছে একটি অদৃশ্য বাতি, যার আলোয় আপনি ভাবছেন, ভালোবাসছেন, স্বপ্ন দেখছেন। এটি একটি জীবন্ত বিদ্যুৎঘর, একটি নিঃশব্দ সুপারকম্পিউটার, যা নিজের জন্য নিজেই শক্তি উৎপন্ন করে।
কবিতার মতো করে বলা যায়—
“নীরব খুলির ছাদে, আলো জ্বলে একা,
মস্তিষ্কের ইচ্ছেরা ছুটে চলে তারপথ বেয়ে,
সেই আলোয়ই আমরা বেঁচে থাকি—
একটি বাল্ব নয়, জ্বলন্ত মহাকাশ মাথার ভেতরে!”
এই আলোকে কখনো হালকা করে দেখবেন না—এটাই আপনাকে মানুষ করে তোলে।