
২০২৫ সাল। মধ্যপ্রাচ্যের পুরনো শত্রুতা এখন নতুন রূপ নিয়েছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ আর শুধু সীমান্তে বা যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, এটি এখন সাইবার মহাকাশে। কোড, ভাইরাস, আর হ্যাকিং প্রযুক্তি এখন নতুন অস্ত্র। এটি সাইবার যুদ্ধের যুগ—যেখানে একটি ক্লিক শত্রুর অবকাঠামো ধ্বংস করতে পারে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে সাইবার যুদ্ধ: ২০২৫
২০২৫ সালের জুনে এসে, মধ্যপ্রাচ্যের পুরনো শত্রুতা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তবে এবারের সংঘাত মূলত যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে, সাইবার মহাকাশে। যুদ্ধের একটি নতুন ও বিপজ্জনক রূপ এখন সাইবার যুদ্ধ, যেখানে বাস্তব বোমা বা গোলার চেয়ে বেশি কার্যকর হয়ে উঠছে কোড, ভাইরাস ও ডিজিটাল হ্যাকিং টেকনোলজি। সাইবার যুদ্ধ বলতে বোঝায় এমন এক সংঘর্ষ যেখানে রাষ্ট্রীয় বা আধা-রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীগুলো ইন্টারনেট, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক এবং সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে আঘাত হানে। আর এই দিক থেকে ইরান ও ইসরায়েল বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় সাইবার শত্রুদ্বয়।
২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ইসরায়েলের বিভিন্ন সরকারি ও সামরিক ডেটাবেইস-এ একাধিক সাইবার আক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যেগুলোর পেছনে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ইরানের সংশ্লিষ্টতা সন্দেহ করা হচ্ছে। গত মে মাসেই ইসরায়েলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পানি পরিশোধন কেন্দ্রে অজ্ঞাত হ্যাকারদের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অচল করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। এই আক্রমণ ইরানের “ইন্ডিপেনডেন্ট সাইবার অপারেশনাল ইউনিট” দ্বারা পরিচালিত বলে ইসরায়েলি সাইবার বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
অন্যদিকে, জুন ২০২৫-এ ইরানের একটি প্রধান রেডিও-টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র ও তেহরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকিং সিস্টেমে বড় ধরনের সাইবার বিঘ্ন ঘটে। সরকারিভাবে দায় অস্বীকার করা হলেও, ইরানি সংবাদমাধ্যমে সরাসরি ইসরায়েলের মসাদ বা সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর দিকেই আঙুল তোলা হয়েছে। এর আগেও ইসরায়েলকে বহুবার ‘স্টাক্সনেট’ জাতীয় ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে হামলার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সাইবার যুদ্ধ এখন ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে। কারণ এই যুদ্ধ তুলনামূলকভাবে কম খরচে, গোপনে ও দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, এবং এটি সরাসরি রক্তপাত ছাড়াও একটি দেশের অবকাঠামোকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘সাইবার পিস ইনিশিয়েটিভ’ জানায়, ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে অন্তত ৩৭টি বড় ধরনের সাইবার আক্রমণ রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগ ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ, জল সরবরাহ, স্বাস্থ্যসেবা এবং যোগাযোগব্যবস্থার ওপর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সাইবার সংঘাত ভবিষ্যতে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রযুক্তিগত যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তার নতুন সংজ্ঞা দাঁড়াবে— কে কতটা সাইবার নিরাপদ। এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং অটোনোমাস সিস্টেম ব্যবহারের হার বাড়ছে, তখন এই ধরনের সংঘাত শুধু একটি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং বৈশ্বিক সাইবার স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে উঠবে। ফলে, ইরান-ইসরায়েলের মধ্যকার সাইবার যুদ্ধ কেবল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিই নয়, গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা কাঠামো পুনর্বিবেচনার দাবি তুলেছে।