
একটি মিসাইল ছোড়া হলো। শত্রুর অবস্থান মাইলের পর মাইল দূরে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মিসাইলটি ঠিক সেই টার্গেটে গিয়ে আঘাত করল! কীভাবে সম্ভব এমন নিখুঁত নিশানা? মিসাইল কি সত্যিই দেখতে পায়?
মিসাইলের হৃদয়ে রয়েছে এর গাইডেন্স সিস্টেম—একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যা মিসাইলকে বলে দেয় কোথায় যেতে হবে, কোন পথে যেতে হবে এবং কখন টার্গেটে আঘাত করতে হবে। এই সিস্টেম মিসাইলকে এমন একটি স্মার্ট রোবটে পরিণত করে, যা নিজের গন্তব্য নিজেই খুঁজে নিতে পারে। কিন্তু এই গাইডেন্স সিস্টেম কীভাবে কাজ করে? চলুন, এর বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে জেনে নিই।
কল্পনা করুন, একটি যুদ্ধবিমান আকাশে উড়ছে। তার ইঞ্জিন থেকে নির্গত হচ্ছে তীব্র তাপ। এই তাপই মিসাইলের জন্য একটি আলোকবর্তিকা! ইনফ্রারেড গাইডেন্স সিস্টেম এই তাপ শনাক্ত করে। এই ধরনের মিসাইল, যাকে আমরা হিট-সিকিং মিসাইল বলি, তাপের উৎসের দিকে ছুটে যায়। এটি এমন একটি শিকারি পাখির মতো, যে শুধু তাপের গন্ধ অনুসরণ করে শত্রুকে খুঁজে বের করে। এই প্রযুক্তি বিশেষ করে যুদ্ধবিমান বা হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর।
আরেকটি অসাধারণ প্রযুক্তি হলো রাডার গাইডেন্স। এই ধরনের মিসাইল নিজেই রাডার তরঙ্গ পাঠায় এবং যখন সেই তরঙ্গ শত্রুর কাছ থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে, মিসাইল সেই দিকে ছুটে যায়। এটি যেন একটি বাদুড়, যে শব্দের প্রতিধ্বনি দিয়ে শিকার ধরে! এই সিস্টেম বিশেষ করে দূরপাল্লার মিসাইল বা এমন পরিবেশে কার্যকর, যেখানে দৃশ্যমানতা কম।
কিছু মিসাইল লেজার গাইডেন্স ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে শত্রুর ওপর আগে থেকে একটি লেজার রশ্মি ফেলা হয়, যা সাধারণত ড্রোন বা সেনারা নিয়ন্ত্রণ করে। মিসাইল এই লেজারের আলো অনুসরণ করে ঠিক টার্গেটে পৌঁছে যায়। এটি যেন একটি ট্রেন, যে রেললাইনের পথ ধরে চলে। এই প্রযুক্তি অত্যন্ত নির্ভুল এবং সুনির্দিষ্ট আঘাতের জন্য ব্যবহৃত হয়।
আধুনিক মিসাইলের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী হলো জিপিএস গাইডেন্স। এই মিসাইলগুলো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কো-অর্ডিনেট বা স্থানের দিকে যাত্রা করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় টমাহক ক্রুজ মিসাইলের কথা, যা জিপিএসের সাহায্যে মাইলের পর মাইল দূরের টার্গেটে অবিশ্বাস্য নির্ভুলতায় আঘাত করতে পারে। এটি এমন একটি ডাকপিয়ন, যে ঠিকানা জানা থাকলে কখনো ভুল পথে যায় না।
কিছু মিসাইল নিজের ভেতরের সেন্সর দিয়ে পথ খুঁজে নেয়। এই ইনর্শিয়াল ন্যাভিগেশন সিস্টেম মিসাইলের গতি, দিক এবং দূরত্ব হিসাব করে। এটি যেন একটি স্মার্ট ঘড়ি, যে নিজের অবস্থান এবং গন্তব্যের হিসাব রাখে। এই প্রযুক্তি বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে কার্যকর, যেখানে বাহ্যিক সংকেত পাওয়া যায় না।
অনেক মিসাইল ছোড়ার আগেই টার্গেট লক করে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু মিসাইল এতটাই উন্নত যে, একবার লক করার পর তাদের থামানো প্রায় অসম্ভব। এই মিসাইলগুলো শত্রুর গতিবিধি অনুসরণ করে, এমনকি শত্রু যদি পালানোর চেষ্টা করে, তবুও তারা পিছু ছাড়ে না। এটি যেন একটি শিকারি, যে শিকারকে ধরা না পর্যন্ত থামে না।
মিসাইল কেবল ধ্বংসের হাতিয়ার নয়, এটি মানুষের প্রযুক্তিগত প্রতিভার একটি নিখুঁত প্রয়োগ। এর পেছনে রয়েছে জটিল গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সমন্বয়। শুধু বারুদ দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়েও তৈরি হয় এমন অস্ত্র। এই প্রযুক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের ক্ষমতা কতটা অসীম!
পরের বার যখন আপনি মিসাইলের কথা শুনবেন, ভাববেন না এটি শুধুই একটি অস্ত্র। এটি একটি উড়ন্ত রোবট, যার মস্তিষ্কে রয়েছে বিজ্ঞানের সেরা নমুনা। এবং ধ্বংসের গল্প, যে গল্পের হাত ধরে মানুষ নিঃস্ব হয়। যুদ্ধাস্ত্রের পরিবর্তে চাই শান্তির উদ্ভাবনের গল্প।