জ্যোতির্বিজ্ঞান

পৃথিবীর এই পরিবেশ প্রথম জীবনে অন্যরকম ছিল, যা জানলে শিহরিত হবেন

যদি আজকের পৃথিবীর মনোরম প্রকৃতি, নীল আকাশ, হিমেল বাতাস আর প্রাণে ভরপুর জীববৈচিত্র্যের দিকে তাকিয়ে ভাবেন—এটাই চিরন্তন বা জন্ম থেকেই পৃথিবীর পরিবেশ এরকমই ছিল, তবে আপনি ভুল করছেন। কারণ পৃথিবীর শুরুতে এর পরিবেশ ছিল একেবারে ভিন্ন, এমনকি ভয়ংকর, বিষাক্ত এবং প্রাণের জন্য মারাত্মক। আর এই ভিন্নতর, ভয়াল পরিবেশের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল প্রথম জীবন। ভাবুন তো, এমন এক পৃথিবী—যেখানে আকাশ ছিল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, মেঘের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, সূর্যের আলো সরাসরি পৌঁছাত না, চারপাশে গলিত লাভা, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, মেঘে-মেঘে বিদ্যুৎ ঝলকানি, আর বাতাসে ছড়িয়ে থাকা বিষাক্ত গ্যাস—এই সবকিছুর মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল প্রাণের প্রথম স্পন্দন!

প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী যখন সদ্য সৃষ্টি হয়েছে, তখন তা ছিল একটি উত্তপ্ত বলয়ের মতো, পৃষ্ঠদেশ ছিল তরল লাভায় পূর্ণ। আর সেই সময়কার বাতাসে অক্সিজেনের লেশমাত্রও ছিল না। বরং কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং অ্যামোনিয়ার মতো বিষাক্ত গ্যাসে ভরা ছিল সেই আদিম বায়ুমণ্ডল। তাপমাত্রা ছিল বহু শত ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে, আর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি এসে পড়ত পৃথিবীর বুকে। এমন পরিবেশে প্রাণ আসবে—এ কথা ভাবাই দুঃসাধ্য ছিল, কিন্তু প্রকৃতির রহস্য এখানেই।

সাগরের গভীরে, যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, সেখানে পানির তলায় হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট নামে বিশাল বিশাল ফুটন্ত ফাটল থেকে নির্গত হওয়া গরম খনিজ তরলের মাঝে, কিছু বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হতে শুরু করে অণুজীব বা মাইক্রোঅর্গানিজম। এই অণুজীবগুলোই ছিল পৃথিবীর প্রথম জীব। কোনো কোষও ছিল না তখন, ছিল কেবল প্রোটিনের মতো কিছু মৌলিক জৈব অণু। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে গঠিত হয় প্রোটোপ্লাজম, এরপর প্রাক-নিউক্লিয়াসধারী কোষ, এবং একসময় একক কোষীয় জীব। অথচ পৃথিবীতে তখনও উদ্ভিদ, পশু, এমনকি অক্সিজেন নির্ভর কোনো শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যবস্থা ছিল না। বরং এইসব আদিম জীব গ্যাস খেয়ে, পাথরের খনিজ চুষে বা সালফারজাত বিক্রিয়ায় টিকে থাকত। তবে পরিবর্তন আসতে শুরু করে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন বছর আগে। কিছু ব্যাকটেরিয়া, বিশেষ করে সায়ানোব্যাকটেরিয়া, সূর্যালোক ব্যবহার করে ফটোসিনথেসিস শুরু করে। আর সেই প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন উৎপন্ন হতে থাকে—যা ধীরে ধীরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে জমা হয়ে আজকের প্রাণবান পরিবেশের ভিত গড়ে দেয়।

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন- BIGGAN tottho

তখনকার পৃথিবী কল্পনা করলে মনে হয় যেন এক জ্বলন্ত নরক, অথচ সেই নরকের মাঝেই লুকিয়ে ছিল প্রাণের উৎস। এ যেন সময়ের গভীরে গড়ে ওঠা এক অনন্য সৃষ্টি, যেখানে মৃত্যুসম ধ্বংস থেকে জন্ম নেয় জীবনের উন্মেষ। আর আজ আমরা—মানবজাতি, সেই ধারাবাহিক জীববিকাশেরই সর্বশেষ প্রতিনিধি। ভাবলে শিহরণ জাগে, আমাদের পূর্বপুরুষ একসময় বেঁচে ছিল এক এমন পৃথিবীতে, যেখানে বাতাসে শ্বাস নেওয়া যেত না, যেখানে আগুন আর গ্যাসে ভরা পরিবেশে জীবন ছিল শুধু সংগ্রাম আর অভিযোজনের গল্প। আর সেই গল্পের প্রতিটি পরত আজও লুকিয়ে আছে পৃথিবীর প্রাচীন শিলা, সমুদ্রতল আর জীবাশ্মে।

এইসব প্রমাণই জানান দেয়—জীবনের ইতিহাস কেবল টিকে থাকার নয়, বরং এক অবিরাম অভিযাত্রার, যেখানে প্রতিকূলতা থেকেই উঠে এসেছে সম্ভাবনার জয়। এই পৃথিবী, আজ আমাদের বাসস্থান, একদিন ছিল প্রাণের জন্য ভয়ংকর নিষ্ঠুর; অথচ সেই পৃথিবীই গড়েছে আজকের প্রাণময় নীল গ্রহ। তাই বলা যায়, প্রকৃতির সবচেয়ে বড় রহস্য হচ্ছে সময়—যা ভয়ঙ্করকে রূপ দেয় জীবনে, আর প্রাণহীনতাকে রূপ দেয় প্রাণের সৃষ্টিতে।

এই ছিল পৃথিবীর আদিম পরিবেশের এক অভূতপূর্ব রূপ—যা জানলে সত্যিই শিহরিত হতে হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button