
বাংলার মাটি, মানুষ, প্রকৃতি এবং ইতিহাস—সবকিছুর অনন্য প্রকাশ ঘটেছে যে মাধ্যমে, তার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো লোকসঙ্গীত। লোকজ এই সঙ্গীত কেবল এক ধরনের গানের ধারা নয়; এটি একটি সামগ্রিক জীবনচর্চা, একটি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়ে এসেছে আমাদের হৃদয় ও রক্তে। আমাদের পূর্বপুরুষদের আনন্দ, বেদনা, আশা, সংগ্রাম ও আত্মিক অনুভূতির যে নিঃশব্দ সাক্ষী—লোকসঙ্গীত ঠিক তাই। এই গানগুলো আমাদের জীবনের সেই দিকগুলোকে তুলে ধরে, যা হয়তো ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লেখা হয় না, কিন্তু হৃদয়ে গেঁথে থাকে চিরকাল।
লোকসঙ্গীতের জন্ম প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে। এটি তৈরি হয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতা ও আবেগের মিশেলে। যুগ যুগ ধরে গ্রামের কৃষক, মাঝি, রাখাল, সাধক কিংবা গৃহস্থ তাঁদের জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, ধর্ম-আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃতির প্রতি মমত্ববোধকে গানে রূপ দিয়েছেন। এই গান ছিল তাদের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম, বিনোদনের উৎস, আবার কোথাও বা আত্মার খোরাক।
বাংলার লোকসঙ্গীত অনেক শাখায় বিভক্ত, প্রতিটি ধারার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, সুর, তাল ও বক্তব্য। কিছু উল্লেখযোগ্য ধারার মধ্যে আছে—
ভাটিয়ালি: নদীভিত্তিক জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই গান মাঝিদের হৃদয় থেকে উৎসারিত। নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলা নৌকার মতোই এই গানের সুরেও আছে এক অনন্ত যাত্রার আবেদন।
বাউল: দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক ভাবধারার নিগূঢ় দর্শন প্রকাশ করে এই গান। বাউলরা গানকে স্রেফ বিনোদনের মাধ্যম না ভেবে আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলনের উপায় হিসেবে দেখেন।
ভাওয়াইয়া: উত্তর বাংলার বিশেষ সুরভঙ্গিমায় গাওয়া এই গানগুলোতে আছে প্রেম-বিরহের তীব্র অনুভূতি এবং জীবনসংগ্রামের চিত্র।
মুর্শিদি ও মারফতি: ইসলামি সুফি চিন্তাধারার প্রভাবে গড়ে ওঠা এই গানে আছে আল্লাহ ও পীর-মুর্শিদের প্রতি প্রেম, আত্মদর্শন ও আত্মশুদ্ধির বার্তা।
লোকসঙ্গীত এককথায় গ্রামের কথা। মাটির গন্ধ, ধানের শীষে হেলেদেওয়া হাওয়া, নদীর বুকে চলা নৌকা, কৃষকের ঘামে ভেজা সকাল, কিংবা গৃহবধূর একাকীত্ব—সবই এই গানের প্রতিটি চরণে উঠে আসে। লোকসঙ্গীত গ্রামবাংলার জীবনদর্শন ও মানসিকতার প্রতিচ্ছবি, যা আধুনিকতার তোড়ে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে আধুনিক ও ডিজিটাল যুগে লোকসঙ্গীত কিছুটা পিছনের সারিতে চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার আবেদন আজও অমলিন। নানা অনুষ্ঠানে, সংস্কৃতি চর্চায়, বা গবেষণার ক্ষেত্রেও লোকসঙ্গীত গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেক শিল্পী ও সংগঠন এই সঙ্গীতকে সংরক্ষণ, প্রচার ও আধুনিক রূপে উপস্থাপন করার কাজ করছেন।
তবে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমাদেরই—এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা, জানা, শেখা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া। কারণ লোকসঙ্গীত কেবল গান নয়, এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের অংশ। শেকড়কে চেনার জন্য, সংস্কৃতিকে ভালোবাসার জন্য, আমাদের এই সুরের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।
বাংলার লোকসঙ্গীত শুধুই অতীত নয়—এটি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন। এর প্রতিটি সুরে, কথায় ও ধ্বনিতে রয়েছে একটি জাতির আত্মা। এই সঙ্গীত আমাদের এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যেখানে আমরা প্রকৃত ‘আমি’-কে খুঁজে পাই। তাই আসুন, আমরা সকলে মিলে এই অমূল্য ঐতিহ্যকে বুকে আগলে রাখি, ছড়িয়ে দিই, যেন বাংলার লোকসঙ্গীত চিরকাল গেয়ে যায় আমাদের জীবনের কথা।