
বাংলা সাহিত্যের আকাশে যিনি এক উজ্জ্বল ধূমকেতু হয়ে উদিত হয়েছিলেন, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁকে শুধু বিদ্রোহী কবি বলে ডাকলে তাঁর পরিপূর্ণ পরিচয় তুলে ধরা হয় না। নজরুল একাধারে কবি, সংগীতস্রষ্টা, সাহিত্যিক, সৈনিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, মানবতাবাদী ও বিপ্লবী চিন্তার ধারক। তবে তাঁর জীবনের অনেক অধ্যায় আমাদের পাঠ্যবই কিংবা প্রচলিত আলোচনার বাইরে থেকে গেছে, যা তাঁর বিদ্রোহী হয়ে ওঠার পেছনে গভীর প্রভাব রেখেছে। এই নিবন্ধে আমরা নজরুলের সেই অনালোকিত অধ্যায়গুলোর একটি সংক্ষিপ্ত, অথচ গভীর অনুসন্ধান করব।
নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, ব্রিটিশ ভারতে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত শৈশবেই তাঁর নাম হয় দুখু মিঞা। ছোটবেলায় মসজিদের মুয়াজ্জিন থেকে শুরু করে হাফেজখানায় শিক্ষকতা, কবর রক্ষকের কাজ—কোনো কাজই করেননি এমন নয়। কিন্তু সেই দুঃখী কিশোরের হৃদয়ে জন্ম নিয়েছিল এক অদম্য প্রতিজ্ঞা—অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। তাঁর জীবনের লেটো দলে যোগ দেওয়ার পর্বটিই ছিল এই বিদ্রোহী চেতনাকে সৃজনের পথে নিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ।
লেটো দলে অভিনয় ও সুরচর্চার পাশাপাশি সমাজের চিত্র পর্যবেক্ষণের যে অভিজ্ঞতা নজরুল সঞ্চয় করেন, তা ছিল কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির চেয়ে গভীর। তাঁর লেখায় পরবর্তীতে এই বঞ্চনার প্রতিবাদ সুর হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু এই পর্যায়ে যে সাংস্কৃতিক চর্চা ও শ্রেণি-সচেতনতাবোধ গড়ে উঠেছিল, তা ছিল নজরুলের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার গোপন ভিত।
যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন, তখন তিনি বুঝতে শিখলেন ক্ষমতার আসল রূপ। করাচি সেনানিবাসে থাকাকালীন সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ কমেনি, বরং আরও প্রখর হয়। সেনাবাহিনীর নিয়ম-কানুন, শৃঙ্খলা এবং বৈদেশিক সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাস তাঁকে এক আন্তর্জাতিক দর্শনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিশেষ করে রুশ বিপ্লব ও পাশ্চাত্যের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নজরুলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই সময়েই তাঁর মধ্যে পরিপূর্ণতা পায় বিদ্রোহের বীজ—সাহিত্যের মাধ্যমে শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি।
কলকাতায় ফিরে এসে তিনি যখন সাহিত্যের মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করলেন, তখন তা যেন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতা শুধু একটি কবিতা নয়, বরং একটি সময়ের বিপ্লবী চেতনার বিস্ফোরণ। এই কবিতার মাধ্যমে নজরুল হয়ে ওঠেন সেই কণ্ঠস্বর, যিনি বলেছিলেন—“আমি চির বিদ্রোহী বীর।” কিন্তু তাঁর এই বিদ্রোহী সত্তার পেছনে ছিল তাঁর বঞ্চনার অভিজ্ঞতা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব এবং সব শ্রেণির মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
নজরুলের সাংবাদিকতা, বিশেষ করে “নবযুগ” এবং “ধূমকেতু” পত্রিকায় কাজ, তাঁকে সরাসরি রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে নিয়ে আসে। “আনন্দময়ীর আগমনে” কবিতা লেখার অপরাধে যখন তাঁকে কারাগারে নেওয়া হয়, তখনও তিনি থেমে যাননি। বরং “রাজবন্দীর জবানবন্দী” রচনার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন যে, জেলখানার দেয়াল তাঁর কণ্ঠস্বর রোধ করতে পারে না। এই সময়ের তাঁর প্রতিটি লেখা একেকটি আগ্নেয়গিরির অগ্নিশিখা, যা শোষকদের হৃদয়ে আতঙ্ক জাগাত।
নজরুল শুধু রাজনৈতিক বিদ্রোহী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিদ্রোহেরও প্রতীক। যখন ভারত উপমহাদেশ ধর্মীয় বিভাজনে বিপর্যস্ত, তখন নজরুল বললেন—মানুষ বড় না, হিন্দু-মুসলমান বড়? তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাটি ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার ফসল। সেনাবাহিনীতে হিন্দু বন্ধুদের সাথে তার সম্পর্ক, এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও ধর্মের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা প্রত্যক্ষ করা তাঁকে এক মানবতাবাদীর রূপ দেয়।
নজরুলের ছোটগল্প ও উপন্যাসগুলোতেও আমরা তাঁর সমাজ সচেতনতাকে খুঁজে পাই। শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ, নারীর অধিকারের প্রতি সম্মান, এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রতিটি লেখায় স্পষ্ট। তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভা যতটা আবেগপ্রবণ, ততটাই যুক্তিনির্ভর এবং লক্ষ্যনির্দিষ্ট।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়। ঢাকায় আসার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। কিন্তু জাতি যে সম্মান তাঁকে দিয়েছে, তা ছিল তাঁর শত সংগ্রাম ও ত্যাগের স্বীকৃতি। ১৯৭৬ সালে তাঁর প্রয়াণ বাংলা সাহিত্যে এক যুগের অবসান ঘটায়।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবন কেবল একটি জীবনী নয়, এটি এক অগ্নিস্নাত যাত্রার ইতিহাস। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—শোষণ, বঞ্চনা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কীভাবে একজন দুখু মিঞা হয়ে উঠতে পারে জাতির বিদ্রোহী কবি। তাঁর সেই অনালোকিত অধ্যায়গুলো আজও আমাদের চেতনার আলো জ্বালায়—বিদ্রোহই যেখানে মুক্তির পথ দেখায়।
– আল মামুন রিটন