
শান্তি চাই,আমরা সবাই শান্তি চাই;
অথচ কেউই আমরা শান্ত নই!
রান্না ঘরের চালের তিনটি শালিকের ঝগড়া যেন কখনও আর শেষ হবার নয়!
চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেওয়ার নীতিতে অশান্তির অন্ধত্ব গ্রাস করেছে গোটা পৃথিবীকে।
মানুষ নাকি সবচেয়ে উন্নত জীব!আর অন্য কোনো জীব একথা বলেনি, মানুষ নিজেই একথা বলেছে।
কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
গোটা পৃথিবীতে আগুন লাগিয়ে মানুষ যদি উন্নত হয়, তাহলে আগ্নেয়গিরি,
দাবানল প্রভৃতি সবচেয়ে উন্নত কিছু হতে পারতো।
সর্বগ্রাসী গনগনে আগুনের লেলিহান শিখায় সমস্তকিছু পুড়িয়ে দিয়ে শান্তির বাণী শোনানোর আজব প্রাণীই হচ্ছে মানুষ। তবুও সে কী করে উন্নত জীব হতে পারে?
মানুষের গুণ সম্পর্কে একটা সাধারণ কথা বলা হয়ে থাকে,যেটা হলো মানবিকতা। সম্ভবত মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণগুলোর সমষ্টিযুক্ত আচরণের বহিঃপ্রকাশই মানবিকতা। এখন সর্বশ্রেষ্ঠ গুণগুলো বলতে আমরা কী বুঝি? দয়া,মায়া,মমতা, কৃতজ্ঞতাবোধ, পরোপকার,ক্ষমা, অহিংসা,লোভহীনতা, সত্যবাদীতা,বিবেকবোধ, মূল্যবোধ প্রভৃতি এগুলোই একজন সম্পূর্ণ মানুষের মানবিকতার বিষয়। মানবিক মানুষের সঙ্গে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের পার্থক্য হচ্ছে মনুষ্যত্বের।
তার মানে যেদিক থেকেই দেখা যাক না কেন প্রকৃত মানুষ না হতে পারলে সব বৃথা। তাহলে প্রকৃত মানুষ কীভাবে তৈরি হতে পারে? কেউ বলবেন শিক্ষার দ্বারা,কেউ বলবেন পরিবেশের দ্বারা,কেউ বলবেন পারিবারিক শিক্ষা-সংস্কৃতির দ্বারা,কেউ বলবেন ধর্মীয় বোধের দ্বারা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে শিক্ষা মূলত দুই প্রকার।এক,প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা; যা মূলত পেশাগত উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা এবং দুই নৈতিক শিক্ষা,যা মূলত চারিত্রিক গুণাবলী বিকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে বলা হয়ে থাকে।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যেও যদিও নৈতিক শিক্ষার সুযোগ আছে, তবে সিলেবাস ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার চাপে নৈতিক শিক্ষার সুযোগ কম থাকে।পারিবারিক সুশিক্ষা ও ভালো সংস্কৃতির দ্বারা লালিত পালিত হলে মানুষের নৈতিক শিক্ষা লাভের সুযোগ যথেষ্ট পাওয়া যায়।
এই পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েই আমাদের প্রাথমিক ধর্মীয় বোধের সৃষ্টি হয় এবং পরিবারটি যে ধর্মে বিশ্বাসী,বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ধর্মবোধেই আমাদের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং পরবর্তীকালে কিছু ক্ষেত্রে নিজধর্মে চূড়ান্ত বিশ্বাসের আবেগজনিত কট্টরপন্থী মনোভাব ও আচরণ দেখা যায়।
ধর্মবোধ হলো মানবিক মানুষের এমন এক উন্নত বোধ যা একজন পরিণত মানুষের পক্ষেই অনুশীলন করা সম্ভব।
আর পরিণত মানুষ হতে গেলে ঐ দুই ধরণের শিক্ষায় যথেষ্ট শিক্ষিত হতে হবে এবং তার চিন্তার ব্যাপ্তি এতো বৃহৎ তথা সর্বজনীন হতে হবে যে,তার চিন্তার সঙ্গে অপর কোনো সাধারণ মানুষের আরোপিত আবেগজনিত বিশ্বাসের আচরণের মধ্যে একটা মূলগত পার্থক্য থাকবেই।এই জন্যই সকল ধর্মের প্রকৃত ধার্মিক মানুষদের মধ্যে কোনো বিতর্ক সাধারণত দেখা যায় না।
আধ্যাত্মিক চেতনার তথা দার্শনিক ভাবনার মধ্যে যেমন ধর্মীয় সদগুণের অভ্যাস করা যায় তেমনি প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারলে অধ্যাত্মবোধের উচ্চ ক্ষেত্রে ভাবনার পরিধি বিস্তৃত হতে পারে না। সেই জন্য শুধুমাত্র আবেগজাত বহিঃপ্রকাশ নয় বরঞ্চ যুক্তিবোধ বিকাশের দ্বারাই আধ্যাত্মিক চেতনার যথার্থ উন্মেষ ঘটা সম্ভব। এই জন্যই কেবলমাত্র যুক্তি ও পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত সত্যগুলোকেই বিজ্ঞানের সূত্র বলা হয় ও সূত্র দ্বারা বিভিন্ন উদ্ভাবনকে বিজ্ঞানের আবিষ্কার বলা হয়ে থাকে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত,বজ্রপাত, ভূমিকম্প, ঝড়বৃষ্টি, দাবানল ইত্যাদি একসময় অশিক্ষিত আদিম মানুষের শুধুমাত্র বিস্ময় ও ভীতির বিষয় ছিল। বর্তমানে বিজ্ঞানের ব্যাপ্তি ও আবিষ্কারের জন্য আধুনিক শিক্ষিত মানুষের যুক্তিবোধ বিকাশের ফলে এইসব প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ ও এক্ষেত্রে মানুষের করণীয় সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা এসেছে।এইরকমভাবে নানা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও আবিষ্কারের প্রতি প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। সেক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক চেতনার ব্যাপ্তিও বেড়েছে এবং বিজ্ঞানচর্চার দ্বারা অতি সূক্ষ্ম পর্যালোচনা করার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।এর সঙ্গে আস্তিকতা নাস্তিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান কখনও নাস্তিকতা বা আস্তিকতার দ্বারা পরিচালিত হয় না,কারণ নাস্তিকতা বা আস্তিকতার সঙ্গে আরোপিত আপাত যুক্তিবোধ ও অন্ধ আবেগের সংমিশ্রণ থাকে যা বিজ্ঞানচর্চায় থাকে না। বিজ্ঞান শুধুমাত্র যুক্তি ও প্রমাণ নির্ভর একটি বিশ্বব্যাপী শিক্ষার ব্যবস্থাপনা যা সমস্ত আরোপিত আপাত যুক্তিবোধ ও আবেগজনিত অন্ধ বিশ্বাস নিরপেক্ষ।
বিজ্ঞানীদের মধ্যেও আস্তিক নাস্তিক সবাই আছেন, যেমন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওই দুই ধরণের মানুষ আছেন। তাই ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চার কোনো সম্পর্ক নেই।
বিজ্ঞান মানে শুধু আবিষ্কার নয়, বিজ্ঞান মানে যেকোনো বিষয় সম্পর্কে বিশেষরূপে জ্ঞান অর্জন করা।
পরিশেষে এটা বলা যায় যে, বিশ্বশান্তির জন্য বিশ্বব্যাপী মানবিক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে বিশ্বনেতাদের মধ্যে অবশ্যই মানবিকতা থাকতেই হবে অন্যথায় শান্তির প্রচেষ্টা বৃথা। কুসংস্কারবর্জিত বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাত্মবোধের অনুশীলন এবং সর্বোপরি সমস্ত ধরণের সুশিক্ষাই একজন মনুষ্যত্বযুক্ত প্রকৃত মানুষের সৃষ্টি করতে পারে। আর তখনই পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসবে।