
স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, মহাবিশ্ববিদ এবং লেখক। তার পিতা ফ্রাঙ্ক হকিং ছিলেন একজন চিকিৎসা গবেষক এবং মাতা ইসোবেল হকিং ছিলেন সচিব। হকিং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস (ALS) নামক একটি বিরল রোগে আক্রান্ত হন, যার ফলে তিনি ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। তা সত্ত্বেও, তিনি তার অসাধারণ মেধা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানের জগতে অসামান্য অবদান রাখেন।
স্টিফেন হকিং-এর গবেষণা মূলত মহাবিশ্বের উৎপত্তি, কৃষ্ণগহ্বর এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর কেন্দ্রীভূত ছিল। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব ও আবিষ্কার নিম্নরূপ:
১. হকিং বিকিরণ-
হকিং-এর সবচেয়ে বিখ্যাত তত্ত্ব হলো “হকিং বিকিরণ”। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রমাণ করেন যে কৃষ্ণগহ্বর সম্পূর্ণ কালো নয়; বরং, কোয়ান্টাম প্রভাবের কারণে তারা ধীরে ধীরে কণা নির্গত করে এবং শক্তি হারায়। এই তত্ত্ব কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কিত পূর্ববর্তী ধারণাকে আমূল বদলে দেয় এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান ও সাধারণ আপেক্ষিকতার মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করে।
২. বিগ ব্যাং তত্ত্ব-
হকিং, রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে গবেষণা করে দেখান যে মহাবিশ্বের উৎপত্তি একটি একক বিন্দু (সিঙ্গুলারিটি) থেকে হয়েছে, যা বিগ ব্যাং নামে পরিচিত। তারা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রমাণ করেন যে মহাবিশ্বের শুরু এবং কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে সিঙ্গুলারিটি বিদ্যমান।
৩. তথ্য প্যারাডক্স-
কৃষ্ণগহ্বরে তথ্য হারিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে হকিং-এর গবেষণা বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। তিনি প্রস্তাব করেন যে কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করা তথ্য চিরতরে হারিয়ে যায়, যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মৌলিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সমস্যা এখনও পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়।
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হকিং-এর বই A Brief History of Time বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই বইয়ে তিনি মহাবিশ্বের উৎপত্তি, সময়ের প্রকৃতি এবং কৃষ্ণগহ্বরের মতো জটিল বিষয় সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজভাবে উপস্থাপন করেন। এটি বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও হকিং কখনো হাল ছাড়েননি। তিনি একটি বিশেষ কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন, যা তার গালের পেশী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ভয়েস সিন্থেসাইজারের সাহায্যে কথা বলতে সক্ষম করত। তিনি দুইবার বিবাহ করেন এবং তার তিন সন্তান রয়েছে।
হকিং-এর জীবন ও কাজ বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার জীবনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র The Theory of Everything (২০১৪) তার সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প তুলে ধরে।
স্টিফেন হকিং ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তার বৈজ্ঞানিক অবদান এবং জনপ্রিয় লেখনী তাকে একজন কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার তত্ত্বগুলো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্য পথপ্রদর্শক।