জ্যোতির্বিজ্ঞান

প্রথমবারের মতো সূর্যের দক্ষিণ মেরুর ছবি পাঠাল সোলার অর্বিটার

প্রথমবারের মতো সূর্যের দক্ষিণ মেরুর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে তা পৃথিবীতে পাঠিয়েছে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ইএসএর সোলার অর্বিটার মহাকাশযান। এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সূর্যের জটিল আচরণ ও সৌর চক্র নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করার দারুণ সুযোগ পেলেন। এই প্রথম কোনো মহাকাশযান সূর্যের দক্ষিণ মেরুর এত কাছে গিয়ে সরাসরি ভিডিও ও ছবি তুলল, যা অতীতে সম্ভব হয়নি।

এগুলো সূর্যের সবচেয়ে কাছ থেকে তোলা এবং সর্বাধিক বিস্তারিত ছবি। এর মাধ্যমে সূর্যের প্রকৃত কাজের ধরন বোঝা সম্ভব হবে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও প্রযুক্তি ব্যবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। কারণ সূর্যের তীব্র সৌর কার্যকলাপ যেমন সৌর ঝড় বা সৌর বিস্ফোরণ, পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইট, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

সোলার অর্বিটার মহাকাশযানের পাঠানো নতুন ছবিগুলোতে দেখা গেছে, সূর্যের চারপাশে রয়েছে এক উজ্জ্বল ও ঝলমলে বায়ুমণ্ডল। এই বায়ুমণ্ডলের কিছু অংশের তাপমাত্রা দশ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। যদিও এর মধ্যে কিছু গ্যাসীয় অন্ধকার মেঘও রয়েছে, যেগুলোর তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা—প্রায় এক লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের এই উত্তপ্ত ও গতিশীল পরিবেশ বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিশেষ ফিল্টার দিয়ে দেখার পর এক তরল গোলকের মতো প্রতীয়মান হয়েছে, যার পৃষ্ঠে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র ঘুরছে এবং এর বায়ুমণ্ডলে গ্যাসীয় অগ্নিশিখা ও বক্ররেখা তৈরি করছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্যের এসব চৌম্বকীয় ক্ষেত্রই মূলত নির্ধারণ করে কখন সূর্য একটি তীব্র ঝড় সৃষ্টি করবে এবং তা পৃথিবীর দিকে কণা ছুঁড়ে দেবে কিনা। সাধারণত প্রতি ১১ বছর পর সূর্য তার চৌম্বকীয় চক্রে অস্থিরতায় পড়ে এবং তখন তার উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর অবস্থান পরিবর্তিত হয়। এ সময় সূর্য বেশি জটিল হয়ে ওঠে এবং শক্তি নির্গত করতে শুরু করে, যার একটি অংশ সৌর ঝড় হিসেবে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। এতে করে একদিকে যেমন স্যাটেলাইট যোগাযোগে সমস্যা তৈরি হয়, বিদ্যুৎ গ্রিড ভেঙে পড়ে, অন্যদিকে এটি পৃথিবীর আকাশে সৃষ্টি করে মনোমুগ্ধকর অরোরা।

এই সৌর চক্র ও ঝড় পূর্বাভাসের জন্য বিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্য এখন সূর্যের একটি নির্ভুল কম্পিউটার মডেল তৈরি করা। এটি তৈরি হলে ‘মহাকাশ আবহাওয়া’র পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হবে, যা স্যাটেলাইট পরিচালনাকারী সংস্থা, বিদ্যুৎ কোম্পানি এবং সৌরঝড় পর্যবেক্ষণকারী গবেষকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে। এই লক্ষ্যে কাজ করছেন অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ওয়েনের নেতৃত্বে গবেষক দল, যারা সোলার অর্বিটারের পাঠানো তথ্য ব্যবহার করে সূর্যের বায়ু নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করছেন।

বিশেষ যন্ত্র ‘স্পাইস’-এর সাহায্যে এই মহাকাশযান সূর্যের নির্দিষ্ট রশ্মি বিশ্লেষণ করছে। এই রশ্মি সূর্যের নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় থাকা হাইড্রোজেন, কার্বন, অক্সিজেন, নিওন ও ম্যাগনেশিয়ামের মতো রসায়নিক উপাদান থেকে নির্গত হয়। বর্ণালী রেখা বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষক দল প্রথমবারের মতো সূর্যের পদার্থ গুচ্ছের গতি নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, কীভাবে সূর্য থেকে কণা সৌর বায়ুর আকারে ছড়িয়ে পড়ছে।

এই অসাধারণ সাফল্যের মাধ্যমে সূর্য সম্পর্কিত গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের আশাবাদ, এই তথ্যগুলো শুধু সৌরঝড় ও মহাকাশ আবহাওয়ার পূর্বাভাসেই নয়, বরং সূর্যের জটিল কাঠামো ও আমাদের মহাবিশ্বে এর ভূমিকা সম্পর্কেও নতুন ধারণা দেবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button