প্রযুক্তি আলাপ

চীনের মহাকাশে সুপারকম্পিউটার নেটওয়ার্ক

চীন প্রযুক্তির জগতে আরেকটি বিপ্লব ঘটাতে প্রস্তুত। পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে এবার মহাকাশে গড়ে তুলছে একটি অত্যাধুনিক সুপারকম্পিউটার স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক, যার নাম ‘স্টার কম্পিউট’। এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের প্রথম ধাপ হিসেবে ইতোমধ্যেই ১২টি স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো হয়েছে, যা গত ১৪ মে ২০২৫ তারিখে উৎক্ষেপণ করা হয়। চূড়ান্ত পরিকল্পনা অনুসারে, এই নেটওয়ার্কে মোট ২,৮০০টি স্যাটেলাইট থাকবে, যা একত্রে এক হাজার পেটা অপারেশন প্রতি সেকেন্ড (POP/s) কম্পিউটিং শক্তি প্রদান করবে। এটি প্রযুক্তির ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

চীনের এডিএ স্পেস, ঝিজিয়াং ল্যাবরেটরি এবং নিঝিয়াং হাই-টেক জোনের সহযোগিতায় নির্মিত এই স্যাটেলাইটগুলো অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তিতে সজ্জিত। প্রতিটি স্যাটেলাইটে রয়েছে ৮ বিলিয়ন প্যারামিটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) মডেল এবং ৭৪৪ টেরা অপারেশন প্রতি সেকেন্ড (TOP/s) গতিতে ডেটা বিশ্লেষণের ক্ষমতা। এই স্যাটেলাইটগুলো নিজেদের মধ্যে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে সক্ষম, যার ফলে পৃথিবীতে ডেটা পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস পায়। ফলস্বরূপ, তথ্য প্রক্রিয়াকরণের গতি এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

‘স্টার কম্পিউট’ প্রকল্পের স্যাটেলাইটগুলোতে রয়েছে অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, যেমন এক্স-রে পোলারাইজেশন ডিটেক্টর। এই ডিটেক্টর গামা রশ্মির বিস্ফোরণের মতো তীব্র মহাজাগতিক ঘটনা শনাক্ত করতে সক্ষম। স্যাটেলাইটগুলো ১০০ গিগাবিট প্রতি সেকেন্ড গতির লেজার লিংকের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত, যা তাদের মধ্যে দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য আদান-প্রদান নিশ্চিত করে। এছাড়া, এই নেটওয়ার্ক সম্মিলিতভাবে ৩০ টেরাবাইট ডেটা সংরক্ষণ করতে পারে এবং থ্রিডি ডিজিটাল টুইন ডেটা তৈরি করতে সক্ষম, যা জরুরি সেবা, গেমিং, স্মার্ট ট্যুরিজম এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে।

‘স্টার কম্পিউট’ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো মহাকাশে একটি শক্তিশালী কম্পিউটিং নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যা পৃথিবী থেকে স্বাধীনভাবে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে। এই নেটওয়ার্ক বৈজ্ঞানিক গবেষণা, জলবায়ু পর্যবেক্ষণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মহাকাশ অনুসন্ধানে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করবে। উদাহরণস্বরূপ, এই স্যাটেলাইটগুলো মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং পৃথিবীর পরিবেশ ও জনজীবনের উপর এর প্রভাব বিশ্লেষণে সহায়তা করবে।
এছাড়া, এই প্রকল্পটি চীনের মহাকাশ প্রযুক্তিতে নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করবে। ১৯৫০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় শুরু হওয়া চীনের মহাকাশ কর্মসূচি এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭০ সালে প্রথম স্যাটেলাইট ‘ডং ফাং হং ১’ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে চীন মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর সক্ষমতা অর্জন করে এবং এখন ‘স্টার কম্পিউট’ এর মতো উদ্ভাবনী প্রকল্পের মাধ্যমে প্রযুক্তির সীমানা প্রসারিত করছে।

‘স্টার কম্পিউট’ প্রকল্পটি চীনের মহাকাশ ও প্রযুক্তি খাতে আধিপত্য বিস্তারের কৌশলের অংশ। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ সুপারকম্পিউটারের মধ্যে ২০২টি ছিল চীনে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৩টির তুলনায় অনেক বেশি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে ‘সামিট’ নামে বিশ্বের দ্রুততম সুপারকম্পিউটার তৈরি করে এগিয়ে যায়, চীনের এই নতুন মহাকাশ-ভিত্তিক সুপারকম্পিউটার নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা যোগ করছে।
অন্যদিকে, এলন মাস্কের স্টারলিঙ্ক প্রকল্পের সঙ্গে ‘স্টার কম্পিউট’-এর তুলনা উঠে এসেছে। স্টারলিঙ্ক মূলত স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছে, যেখানে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৭,০০০-এর বেশি স্যাটেলাইট কক্ষপথে রয়েছে। তবে, ‘স্টার কম্পিউট’ ইন্টারনেট সেবার পরিবর্তে মহাকাশে কম্পিউটিং শক্তি বৃদ্ধির উপর জোর দিচ্ছে, যা এটিকে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করছে।

এই প্রকল্পটি যেমন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে। মহাকাশে এত বড় সংখ্যক স্যাটেলাইট মোতায়েন করা মহাকাশের পরিবেশ এবং কক্ষপথে অন্যান্য স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়া, চীনের প্রযুক্তি খাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগও উঠেছে। যেমন, সম্প্রতি চীনের সৌর প্রযুক্তির হার্ডওয়্যারে গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য ব্যাকডোর স্থাপনের অভিযোগ উঠেছে, যা এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

চীনের ‘স্টার কম্পিউট’ প্রকল্প মহাকাশ প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণরূপে চালু হলে, এটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্প খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষ করে, এআই-চালিত স্যাটেলাইটগুলো জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এছাড়া, এই প্রকল্প চীনের মহাকাশে নিজস্ব স্পেস স্টেশন ‘তিয়ানগং’-এর সঙ্গে সমন্বয় করে আরও জটিল মিশন পরিচালনার পথ প্রশস্ত করতে পারে।
চীনের এই উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ‘স্টার কম্পিউট’ প্রকল্প কেবল চীনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার প্রমাণই নয়, বরং মানবজাতির জন্য মহাকাশের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button