জ্যোতির্বিজ্ঞান

চিলির পর্বতমালায় ‘কসমিক ডন’ সংকেত

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, সম্প্রতি মহাকাশ বিজ্ঞানীরা চিলির আন্দিজ পর্বতমালায় বসানো একটি টেলিস্কোপ দিয়ে গত প্রজন্মের সবচেয়ে প্রাচীন আলোর একটি সংকেত ধরতে পেরেছেন। প্রথমবারের মতো পৃথিবীভিত্তিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে “কসমিক ডন” যুগের আলো (প্রায় ১৩ বিলিয়ন বছর আগের) পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। আসলে চিলির ওই বিশেষ টেলিস্কোপগুলো দিয়ে মহাবিশ্বের প্রথম তারাদের ছড়িয়ে দেওয়া অতিপ্রাচীন পোলারাইজড আলোর অঙ্কন শনাক্ত করা হয়েছে। এই সাফল্য প্রমাণ করেছে যে, সঠিক প্রযুক্তি ও শুষ্ক পরিবেশের পর্বতমালায় টেলিস্কোপ স্থাপনের মাধ্যমে পৃথিবীর মাটিতেও বিগ ব্যাংয়ের পর মুহূর্তের আলোকে ধরা সম্ভব। এতে আমরা মহাবিশ্বের প্রথম তারাগুলি কেমন আলোকপ্রভাব ফেলেছিল তা জানতে পারবো এবং ব্রহ্মাণ্ডের শুরু থেকেই বিরাজমান অজানা রহস্যগুলো উন্মোচনে নতুন দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে।

ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে ঘটে এবং প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিশ্বজগৎের উদ্ভব হয়। বিগ ব্যাংয়ের প্রথম লক্ষ লক্ষ বছরের পর মহাবিশ্ব ছিল সারাক্ষণ ইলেকট্রনের ঘন কুয়াশায় আবৃত। তখন Universe-এ আলো মুক্ত হওয়া অসাধ্য ছিল – ৩৮০ হাজার বছর পর প্রোটন-মাঝের প্রথম নিউট্রনগুলো ইলেকট্রনকে আঁটিয়ে নিয়েছিল, ফলে মহাবিশ্বে নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন পরমাণু সৃষ্টি হয়ে যান এবং Universe স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। শীতল হওয়া মহাবিশ্বের সেই সময় থেকে মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB) আলোর তরঙ্গগুলি নিরবচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

Universe শীতল হয়ে একবিন্দুতে স্থির হয়ে গেলে ফের ভোরের সূচনা হয়। প্রায় ১০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন বছর পর প্রথম নক্ষত্রগুলো সৃষ্টি পায়; এই সময়কেই “কসমিক ডন” বা ‘প্রথম আলোর ভোর’ বলা হয়। এই প্রথম তারাগুলো অতিবেগুনি (UV) আলোতে মহাবিশ্বের মধ্যবর্তী স্বচ্ছ হাইড্রোজেন গ্যাসগুলোকে পুনরায় আয়নায়ন করে, প্রচুর ইলেকট্রন মুক্ত করে দেয়। সেই মুক্ত ইলেকট্রনসমূহ বিগ ব্যাংের অবশিষ্ট মাইক্রোওয়েভ আলোর সাথে সংঘর্ষ করে আলোর পথে বাঁক সৃষ্টি করে; ফলে এই অতিপ্রাচীন আলোর তরঙ্গদলে একটি সূক্ষ্ম “পোলারাইজেশন” সংকেত তৈরি হয়। সহজ করে বললে, একধরনের জ্যোতির্ময় ‘ছায়াচিহ্ন’ প্রতিপন্ন হয় যাকে পর্যবেক্ষণ করে আমরা প্রথম তারাদের শক্তি ও প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।

চিলির আন্দিজ পর্বতমালায় বসানো CLASS (Cosmology Large Angular Scale Surveyor) প্রকল্পের টেলিস্কোপ দুটি চিত্রে দেখা যাচ্ছে। উঁচু প্রস্থানে নির্মিত এই পর্যবেক্ষণশালা NSF (জাতীয় বিজ্ঞান ফাউন্ডেশন) দ্বারা অর্থায়িত এবং জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নেতৃত্বে পরিচালিত। CLASS টেলিস্কোপগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল পর্যবেক্ষণ যন্ত্র, বিশেষ করে মাইক্রোওয়েভ ব্যান্ডের আলোর পোলারাইজেশনের সূক্ষ্ম দাগ ধরার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণায় CLASS পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া ডেটা ব্যবহার করে একটি দল মহাবিশ্বের প্রথম তারাদের আলোর হস্তছাপ খুঁজে পেয়েছে। তারা টেলিস্কোপের মাধ্যমে মাপা পোলারাইজড মাইক্রোওয়েভ আলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে কসমিক ডনের একটি পরিষ্কার চিত্র তৈরি করেছেন। এর আগে এই ধরনের সংকেত শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র মহাকাশযান দিয়ে – যেমন NASA-র WMAP বা ESA-র Planck গবেষণা মহাকাশযানগুলো। পৃথিবীভিত্তিক পর্যবেক্ষণে অতিপ্রাচীন আলো এত নিখুঁতভাবে পাওয়া যাবে বলে অনেকেই কল্পনাও করেনি।

গবেষকরা CLASS টেলিস্কোপের তথ্য প্ল্যাঙ্ক ও WMAP-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর ফলে মহাকাশ-বিষণ্ণতা ও অন্যান্য বিঘ্ন অপসারণ করে মহাজাগতিক পোলারাইজড সংকেতটিকে আলাদা করা সম্ভব হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, সাধারাণ দর্শনের জন্য যখন সূর্যের আলো গাড়ির হুডের ওপর আঁধার সৃষ্টি করে, তখনই আলোর পোলারাইজেশন ঘটে; CLASS ডেটা থেকে সেই ‘আলোর গ্লেয়ার’ সরিয়ে দিয়ে দেখা সম্ভব হয়েছে কসমিক ডনের সত্যিকারের আলো।

এই আবিষ্কার মহাবিশ্বের প্রাচীন ইতিহাস বুঝতে নতুন আলোর রশ্মি এনে দিয়েছে। CLASS পর্যবেক্ষণ পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে যে প্রথম তারাদের অতিবেগুনি আলোর প্রভাব কেমন করে পটভূমির মাইক্রোওয়েভ আলোকে পরিবর্তিত করেছে। গবেষকরা বলছেন, “পুনঃআয়ন সংকেতের সূক্ষ্ম পরিমাপ CMB গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক”। এর ফলে প্রথম তারাদের গঠন, জীবাশ্মধ্রুব দ্রব্য (dark matter) এবং নিউট্রিনোর মতো অপেক্ষাকৃত অদেখা কণার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও পরিমার্জিত হবে। অপর দিকে, CLASS পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া নতুন ম্যাপগুলো মহাকাশীয় পটভূমির আলোর ছবি আরও ‘নিখুঁত’ করতে সাহায্য করছে। সাধারণ কথায়, এখন আমরা Universe-এর ভোরে কি ঘটেছিল তার আরও পরিষ্কার ছবি আঁকতে পারব।

গবেষণার মূল তথ্যগুলো এভাবে সারসংক্ষেপ করা যায়:

-প্রথমবার পৃথিবীর মাটিতে থাকা টেলিস্কোপের মাধ্যমে ১৩ বিলিয়ন বছর আগের অতিপ্রাচীন আলোর সংকেত ধরা পড়েছে।

-সংকেতটি প্রমাণ করে যে প্রথম তারাগুলো অতিবেগুনি আলো দ্বারা মাঝের হাইড্রোজেন গ্যাস আয়নায়ন করেছিল এবং মুক্ত ইলেকট্রনসমূহ বিগ ব্যাংয়ের আলোকে বিকৃত করে ফেলে।

-এই পর্যবেক্ষণ ব্রহ্মাণ্ডের ভোরের দিক সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে নতুন করে দাঁড় করাবে এবং ডার্ক ম্যাটার ও নিউট্রিনোর বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ে দিকনির্দেশনা দেবে।

এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, সঠিক প্রযুক্তি এবং উচ্চতায় টেলিস্কোপ স্থাপনের মাধ্যমে পৃথিবী থেকেও মহাবিশ্বের গহীনে আঁকা একটি ছবি পাওয়া সম্ভব। CLASS পর্যবেক্ষণের পরবর্তী ডেটা বিশ্লেষণ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ আমাদের মহাবিশ্বের “ভোরের” চিত্রকে আরও পরিষ্কার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সূত্র: আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং বিজ্ঞান সম্পর্কিত নিবন্ধ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button